আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী একটি অরাজনৈতিক শিয়া মুসলিম ধর্মীয় সংগঠন, যা ১৯৫৭ সালে খুলনার শিয়া জনগণের ধর্মীয় চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। সে সময়ের কমিটি স্থানীয় শিয়া জনগণের অনুদানে খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আলতাপোল লেনে ৫০ শতক জমি ক্রয় করেন। পরবর্তীতে সেখানে একতলা ইমামবারগাহ নির্মিত হয়, যা “কাসরে হুসেইনি” নামে পরিচিত এবং যেখানে তিন শতাধিক লোক একসঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারেন। বিশেষ করে পবিত্র মুহাররম মাসে নারীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুবিধার্থে ইমামবারগাহ ভবনের পেছনের অংশে একটি হল নির্মাণ করা হয়, যা মূল ভবনের সঙ্গে একটি দরজার মাধ্যমে সংযুক্ত, যাতে নারীরা সহজেই প্রবেশ করতে পারেন এবং তাদের নিজস্ব প্রোগ্রাম যেমন মজলিস, মাহফিল ইত্যাদি পরিচালনা করতে পারেন।
এছাড়াও, সদস্যদের অনুদান ও অন্যান্য উৎস থেকে সংগৃহীত অর্থে সে সময়ের কমিটি ইমামবারগাহর দক্ষিণ পাশে একটি একতলা আবাসিক ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যা নির্মিত হয় সত্তর দশকের শেষ দিকে।
উন্নয়ন কার্যক্রম ধীরে ধীরে গতি পায় এবং একতলা আবাসিক ভবনটি পরবর্তীতে দ্বি-তলায় উন্নীত হয়।
সমাজের প্রয়োজন বিবেচনায় রেখে এবং খুলনা ছাড়াও সারা দেশের প্রেক্ষাপটে আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানীর বিস্তৃত কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করে একটি নতুন গঠনতন্ত্র প্রণীত হয়। আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যসমূহ নিচে দেওয়া হলো:
০১। এই সংগঠনের নাম আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী, খুলনা।
০২। এই সংগঠনের সরকারি ও স্থায়ী ঠিকানা ১২, আলতাপোল লেন, খুলনা, বাংলাদেশ।
০৩। জাফরী মাযহাব অনুসারীদের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য কাজ করা।
০৪। মহান নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের (আ.) অনুসারী হিসেবে এই সংগঠন ইমামবারগাহ, মসজিদ, মাদ্রাসা, সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা ও নির্মাণ করবে। এছাড়াও এটি ধর্মীয় শিক্ষা, নৈতিকতা ও আত্মিক উন্নয়নের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে ও উলামায়ে কেরামের দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হবে।
০৫। পবিত্র মুহাররমসহ অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা।
০৬। জাফরী মাযহাব অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় দিবসসমূহ স্মরণে বৈঠক, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, র্যালি, মজলিস, মাহফিল ইত্যাদি আয়োজন করা।

০৭। শিয়া আকিদাভিত্তিক ধর্মীয় বই, সাময়িকী, ম্যাগাজিন, ধর্মীয় প্রবন্ধাদি প্রকাশ করা।
০৮। একটি শিক্ষিত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সমাজের শিশুদের জন্য ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
০৯। সমাজের দরিদ্র ও অবহেলিত সদস্যদের জন্য খাদ্য ও বস্ত্রের ব্যবস্থা করা।
১০। শিয়া মাযহাবের অনুসারীদের মধ্যে ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলা।
১১। অন্যান্য মুসলিম মাযহাবের অনুসারীদের সাথেও ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
১২। সংগঠনের তহবিল সংগৃহীত হবে সদস্যদের কাছ থেকে সংগৃহীত অর্থ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুদান, যাকাত, খুমস ইত্যাদির মাধ্যমে।
‘খুমস’ শব্দের আভিধানিক অর্থ এক-পঞ্চমাংশ বা ২০%। ইসলামী পরিভাষায় খুমস হলো একজন ব্যক্তি যে সম্পদ অর্জন করে, তার নির্দিষ্ট অংশ (এক-পঞ্চমাংশ) ইসলামী বিধান হিসেবে প্রদান করা বাধ্যতামূলক। সহজভাবে বললে আয়ের উদ্বৃত্ত অংশের এক-পঞ্চমাংশ প্রদান করাকেই খুমস বলা হয়।
খুমসকে দুটি ভাগে ভাগ করতে হয়। এক ভাগ হলো ‘সাহমে সাদাত’, এটি এমন সাইয়েদকে দিতে হয় যিনি গরিব, এতিম অথবা ভ্রমণকালে অর্থসংকটে পড়েছেন। দ্বিতীয় ভাগ হলো ‘সাহমে ইমাম (আ.)’। ইমামের গায়েবতের সময় এই অংশ একজন ন্যায়পরায়ণ মুজতাহিদের কাছে প্রদান করতে হয়, যিনি এই অর্থ শরিয়তের বিধান অনুযায়ী ব্যয় করেন।
মুজতাহিদ প্রয়োজনে আলেমদের খুমস গ্রহণের অনুমতি (আজাজা) দিতে পারেন এবং সেই চিঠিতে উল্লেখিত শর্ত অনুযায়ী ধর্মীয় কাজে খরচ করার অনুমোদনও প্রদান করতে পারেন।
এই প্রেক্ষাপটে, হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়েদ ইব্রাহিম খলিল রজাভী, প্রিন্সিপাল, ইসলামী এডুকেশন সেন্টার, খতিব ও ইমামে জামা’ত, মসজিদে ওয়ালী আসর (আ.ফ.স.), খুলনা এবং সভাপতি, আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী, একাধিক বিশিষ্ট মুজতাহিদ ও মারাজা-এ-কেরাম এর কাছ থেকে খুমস গ্রহণ ও তা ধর্মীয় কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করার অনুমতি (আজাজা) লাভ করেছেন, যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
সংবিধান অনুযায়ী, আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী ১৩ (তের) সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হবে কমিটি স্থানীয় শিয়া সাধারণ সদস্যদের কর্তৃক প্রতি তিন বছর অন্তর নির্বাচন বা মনোনয়নের মাধ্যমে গঠিত করা হবে।
এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৯৯১ সালে ধর্মীয়-সাধারণ শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান “ইসলামী এডুকেশন সেন্টার” প্রতিষ্ঠিত হয়। হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়েদ আফতাব হোসাইন নকভী প্রথম প্রিন্সিপাল হিেেব দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কয়েকজন শিক্ষার্থী নিয়ে এই প্রকল্প শুরু হয়। এক বছর পর হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়েদ ইব্রাহিম খলিল রাজাভী ইসলামী এডুকেশন সেন্টারের প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগদান করেন। তার যোগদানের পর থেকে সকল ধর্মীয় ও শিক্ষা কার্যক্রম গতিশীল হতে থাকে এবং স্থানীয় মোমিনদের সহযোগিতায় তিনি ১৯৯৩ সালের শেষ দিকে ইমামবারগাহ’র উপর “মসজিদে ওয়ালী আসর (আ.ফ.স.)” নির্মাণ করেন।
তিনি সমাজের দরিদ্র নারী সদস্যদের আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে সেলাই প্রশিক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করেন যাতে তারা সাবলম্বী হতে পারেন। কিন্তু নানা কারণে এই প্রকল্প দীর্ঘস্থায়ী হয়নি এবং এক পর্যায়ে তা বন্ধ হয়ে যায়।
এখানে উল্লেখ্য, আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিবেচনা করে কমিটি ইসলামী এডুকেশন সেন্টারের কার্যক্রম শুরু করার জন্য সংগঠনের দুই তলা ট্রাস্ট বিল্ডিং ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়েদ ইব্রাহিম খলিল রাজাভী তার দুই বছরের মেয়াদ শেষ করে ইরানে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে চলে যান এবং তার স্থলে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়েদ এহসান হোসাইন হুসাইনি প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৫ সালে হুজ্জাতুল ইসলাম সাইয়েদ ইব্রাহিম খলিল রাজাভী পুনরায় খুলনায় পত্যাবর্তন করেন এবং হাউযা-এ-ইলমিয়া ক্বোম-এর একাডেমিক সহযোগিতায় একটি হাউযা-এ-ইলমিয়া প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন, যা খুলনা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। পাশাপাশি, বাংলাদেশের দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তায় তিনি পূর্বের প্রচলিত সাধারণ শিক্ষার কার্যক্রমকে আরও উন্নীত করেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের আরও বেশি শিক্ষার্থী একাডেমিক সেকশনে ভর্তি হয়। হাউযা-এ-ইলমিয়ার ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার কার্যক্রম ও সাফল্যের সাথে পরিচালিত হচ্ছে।
আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। যেমন ু ১ থেকে ১০ মহররম (আশুরা), এবং ইমাম হুসাইন (আ.)-এর চেহলুম যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়। আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী থেকে প্রতিবছর ইমাম হুসাইন (আ.)-এর চেহলুমের শোক মিছিল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ আরবাইনের মিছিল হিসেবে বিবেচিত হয়। খুলনা বিভাগের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শোকাভিভূত মানুষ প্রতিবছর এই শোক মিছিলে অংশগ্রহণ করেন।
এছাড়াও, আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী ইমাম ও মাসুমিন (আ.)-এর পবিত্র জন্ম ও শাহাদাতের দিবসসমূহ যথাযোগ্য মর্যাদা ও ধর্মীয় আবেগ নিয়ে পালন করে থাকে।
এই ধর্মীয় কার্যক্রম ছাড়াও, আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী বিভিন্ন দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তায় প্রকাশনা, মুদ্রণ ইত্যাদি কাজও করে থাকে।
তদুপরি, আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী সামাজিক কর্মকাণ্ডেও নিয়োজিত যেমন-গ্রামীণ এলাকার দরিদ্র বিধবা ও বৃদ্ধদের আর্থিক সহায়তা, বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় মক্তব পরিচালনায় সহযোগিতা ও মক্তব শিক্ষকদের যৎসামান্য প্রদান, বিভিন্ন শিয়া মসজিদের মুয়াজ্জিনদের ভাতা প্রদান, সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষালাভরত শিক্ষার্থীদের অর্থ সহায়তা প্রদান।

অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে খুলনার ৪ জন দরিদ্র শিয়া সদস্য যারা পূর্বে রিকশাচালক ছিলেন, তাদেরকে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক প্রদান করা হয়।
বর্তমানে এই প্রকল্পটি কিছুদিনের জন্য স্থগিত রয়েছে। আমরা আমাদের ওয়েবপেজে সময়ে সময়ে এসব কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রকাশ করব।
উল্লেখ্য যে, আঞ্জুমান-এ-পাঞ্জাতানী ১৮৮৮ সালের সোসাইটি অ্যাক্টের অধীনে নিবন্ধিত একটি সংগঠন।








