ইবাদত কি?
আমাদেরকে সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য ইবাদত করা। কুরআন ঘোষণা দিচ্ছে: “ওয়া মা খালাক্বতুল জিন্না ওয়াল ইন্সা ইল্লা লিইয়া’বুদুন। (সূরা: যারিয়াত, ৫৬তম আয়াত।)”
যেসব কাজ আমরা আঞ্জাম দিচ্ছি তা যদি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে হয় তবে তা হবে ইবাদত। যেমন: কর্ম ও উপার্জন, বিদ্যার্জন, বিয়ে-শাদি অথবা জনগণের কল্যাণের নিমিত্তে কাজ, যদিও এগুলি নিজের কিংবা সমাজের প্রয়োজনাদি মিটানোর নিমিত্তে হয়ে থাকে।
যা একটি কাজকে ইবাদতে পরিণত করতে পারে তা হচ্ছে এই যে, কাজটি যেন সদুদ্দেশ্যে বাস্তবায়িত হয় এবং কুরআনের ব্যাখ্যানুসারে আল্লাহর রঙ্গে রঞ্জিত (সিব্গাতাল্লাহি) (সূরা: বাক্বারাহ, ১৩৮তম আয়াত) হয়।
স্বভাব ও ইবাদত
আমাদের কতক কাজ অভ্যাসগত আর কতক স্বভাবজাত। যেগুলি অভ্যাসগত সেগুলি মূল্যবান হতে পারে, যেমন শরীর চর্চার অভ্যাস। আবার সেগুলি ম‚ল্যহীনও হতে পারে, যেমন ধূমপানের অভ্যাস। কিন্তু কাজটি যদি স্বভাবজাত হয়, অর্থাৎ নিষ্কলুষ স্বভাব ও প্রকৃতি যা আল্লাহ প্রতিটি মানুষের অবকাঠামোর মাঝে সন্নিবেশ করেছেন তার ভিত্তিমূলের উপর বাস্তবায়িত হয় তবে সর্বসময়ের জন্যে তা মূল্যবান।
অভ্যাসের উপর স্বভাবের প্রাধান্য এই যে, স্থান ও কাল, বংশ ও লিঙ্গ, বছর ও বয়স তার উপর কোনোরূপ প্রভাব ফেলতে পারে না। আর প্রত্যেক মানুষ, মানুষ হওয়ার দিক হতে তার ধারক বা অধিকারী; যেমন সন্তানসন্ততির ভালবাসা যা বংশ ও সময় বিশেষের সঙ্গে সংযুক্ত নয় এবং প্রত্যেক মানুষই স্বীয় সন্তানসন্ততিকে ভালবাসে। কিন্তু অন্য বিষয়াদি, যেমন খাদ্য অথবা পোষাকের আকৃতি ও বাহ্যিক অবয়ব, এগুলি অভ্যাসগত বিষয় এবং স্থান ও কালের ভিন্নতায় তা পরিবর্তনশীল। কতক
375
জায়গায় একটি জিনিষ প্রচলিত আছে যা অন্য জায়গায় প্রচলিত নয়।
ইবাদত ও পূজা-অর্চনাও একটি স্বভাবজাত বিষয়। আর এ কারণে এটি মানব কাঠামোর প্রাচীনতম, সুন্দরতম ও দৃঢ়তম নিদর্শন যা মন্দির, মসজিদ, প্যাগোডা ও যরথুস্ত্রদের অগ্নিমন্দিরের সঙ্গে সংশি¬ষ্ট। অবশ্য পূজা-অর্চনার প্রকার ও কাঠামোর মাঝে বহু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। এক পার্থক্য হচ্ছে মাবুদগুলির মধ্যে যা পাথর, কাঠ ও মূর্তিসমূহের পূজা-অর্চনা হতে শুরু করে শক্তিশালী আল্লাহ পর্যন্ত, আর অপরটি হচ্ছে ইবাদতের পদ্ধতি ও ধরনে যা নৃত্য ও বিনোদন হতে শুরু করে, যাতে আল্লাহ্র ওলীদের অতি খাঁটি ও গভীরতম প্রার্থনাগুলো পর্যন্ত পার্থক্য করে।
মানুষের মাঝে ইবাদতের আত্মা সৃষ্টি করাও নবীগণের উদ্দেশ্য ছিল না। বরং মাবুদের সত্তা ও ইবাদতের কাঠামোর সংশোধন করা ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। বিশাল অংকের অর্থ যা গীর্জা, প্যাগোডা, মন্দির ও মসজিদের বিল্ডিংগুলিতে খরচ হয়ে থাকে, জাতীয় পতাকা, দেশ ও কুস্তিগীরকে সম্মানিত মনে করা, পূর্ণতার প্রতি আকর্ষণ, বিভিন্ন ব্যক্তি এমনকি বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্যায়ন করা, এসবই মানুষের অস্তিত্বে ইবাদতের আত্মা হতে প্রকাশ লাভ করেছে।
সেইসব লোক যারা আল্লাহর ইবাদত করে না তারা স¤পদ ও পদমর্যাদা অথবা স্ত্রী ও সন্তানসন্ততি অথবা সার্টিফিকেট, মতাদর্শ ও নিয়ম-পদ্ধতির পূজা করছে এবং প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়া পর্যন্ত সে পথেই প্রেমাসক্তভাবে এগুতে থাকে, আর স্বীয় অস্তিত্বকে তদীয় মাবুদের নিমিত্তে বিসর্জন দেয়। ইবাদত করার একটি গভীর স্বভাবজাত প্রবণতা মানুষের মাঝে বিদ্যমান, মানুষ যদিও সে সম্পর্কে অনবগত রয়েছে।
মৌলভীর ভাষায়:
হামচুন মেইলে কূদাকান বা মাদারা-ন,
সিররে মেইলে খোদ নাদানাদ দার লাবান।
অর্থাৎ মায়েদের সঙ্গে শিশুদের ভালবাসা যেরূপ, স্বীয় ভালবাসার গোপন রহস্য জানে না তার ওষ্ঠযুগল।
মহাবৈজ্ঞানিক আল্লাহ্ মানুষের মাঝে সর্বপ্রকারের ভালবাসা ও সহজাত প্রবণতা সন্নিবেশ করতঃ বহির্জগতে তার সন্তুষ্টি ও নিরাপত্তা বিধান করেছেন। মানুষের মাঝে যদি পিপাসার উদ্রেক হয়, তবে তার জন্যে পানি সৃষ্টি করেছেন, আর যদি ক্ষুধার উদ্রেক হয়, তবে খাদ্যও রয়েছে। লিঙ্গগত প্রবণতা যদি মানুষের মাঝে সৃষ্টি করেছেন, তবে তার জন্যে যুগল সৃষ্টি করেছেন, আর যদি তার মাঝে ঘ্রাণশক্তি সৃষ্টি করেছেন, তবে তার জন্যে ঘ্রাণ নেওয়ার উপাদানও সৃষ্টি করেছেন।
মানুষের গভীরতম অনুভূতির মধ্যে একটি হচ্ছে অসীমত্ব কামনা, পূর্ণতা লাভের বাসনা ও অবিনশ¡রতার প্রতি আকর্ষণ। আল্লাহর সঙ্গে সমúর্ক ও তাঁর ইবাদত এ সমস্ত স¡ভাবজাত চাহিদার যোগান দিয়ে থাকে। নামায ও ইবাদত হচ্ছে পরিপূর্ণ উৎসের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক স্থাপনকারী, প্রকৃত প্রেমিকের সঙ্গে সখ্যতা সৃষ্টিকারী এবং অসীম ক্ষমতার নিকট আশ্রয় দানকারী।
সূত্র : তাফসীরে নামায গ্রন্থ থেকে
মূল: হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমীন মোহ্সেন ক্বারাআতী
অনুবাদ ড. এম. এ. কাইউম
ড. এইচ. এম. এ. হান্নান
এস. এম. এ. জাববার