কারবালা ট্রাজেডির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

by Syed Yesin Mehedi

কীভাবে নবীর (সা.) উম্মতই নবীর (সা.) সন্তানকে হত্যা করলো (!) -এ জিজ্ঞাসা সবযুগের প্রতিটি বিবেকবান মানুষের। আর এ ধরনের প্রশ্ন জাগাটাও খুব স্বাভাবিক। কেননা,ইমাম হোসাইনের (আ.) মর্মান্তিক শাহাদাত এক বিষাদময় ঘটনা কিংবা আল্লাহর পথে চরম আত্মত্যাগের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্তই শুধু নয়,এ ঘটনাকে বিশ্লেষণ করলে বড়ই অদ্ভুত মনে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর তিরোধানের মাত্র ৫০ বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই এ হত্যাকাণ্ড চালানো হয়। আর এ হত্যাকাণ্ডের নায়ক ছিল স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (সা.) উম্মত যারা রাসূল এবং তার বংশকে ভালবাসে বলে ইতোমধ্যেই খ্যাতিলাভ করেছিল। তাও আবার রাসূলের (সা.) সেইসব শত্রুদের পতাকাতলে দাড়িয়ে মুসলমানরা রাসূলের (সা.) সন্তানের উপর এ হত্যাকাণ্ড চালায় যাদের সাথে কি-না রাসূলুল্লাহ (সা.)র তিন-চার বছর আগ পর্যন্ত ও অব্যাহতভাবে যুদ্ধ করে গেছেন!

মক্কা বিজয়ের পর যখন চারদিকে ইসলামের জয়জয়কার তখন ইসলামের ঐ চির শত্রুরাও বাধ্য হয়েই নিজেদের গায়ে ইসলামের একটা লেবেল লাগিয়ে নেয়। তাই বলে ইসলামের সাথে তাদের শত্রুতার কোনো কমিত ঘটেনি। এ প্রসঙ্গে হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসিরের উক্তিটি সুপ্রযোজ্য । তিনি বলেছিলেন-

استسلموا و لم یسلموا

 তারা মুসলমান হয়নি,ইসলাম গ্রহনের ভান করেছিল মাত্র।

আবু সুফিয়ান প্রায় ২০ বছর যাবত রাসূলুল্লাহর (সা.) সাথে যুদ্ধ করে। শুধু তাই নয়, শেষের দিকে ৫/৬ বছর সে ইসলামের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এবং ফেতনা সৃষ্টিতে সরদারের ভূমিকা পালন করে।মোয়াবিয়া তার পিতার কাধে কাধ মিলিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতায় নামে। এভাবে আবু সুফিয়ানের দল অর্থাৎ উমাইয়ারা ইসলামের চরমতম শত্রুতে পরিণত হয়। অথচ আমরা অত্যন্ত আশ্চর্যের সাথে প্রত্যক্ষ করি যে ,রাসূলুল্লাহর (সা.) ওফাতের মাত্র দশবছর পরে সেই মোয়াবিয়া এসে ইসলামী শাসনযন্ত্রের শীর্ষে আরোহণ করে শাম বা সিরিয়ার গভর্ণর হয়ে বসে। আরও বিশবছর পরে ইসলামের এই শত্রু হয়ে বসলো স্বয়ং মুসলমানদের খলীফা! এখানেই শেষ নয়,রাসূলের (সা.) মৃত্যুর পর পঞ্চাশ বছর পর এবার মুসলমানদের খলীফা হল মোয়াবিয়া-পুত্র ইয়াযিদ। আর এই ইয়াযিদ নামায,রোযা,হজ্ব যাকাত তথা ইসলামের বিধি-বিধান পালনকারী মুসলমানদেরকে সাথে নিয়ে অর্ধশতাব্দী গড়াতে না গড়াতেই রাসূলের (সা.) সন্তানকে হত্যা করলো। এসব নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মাথা বিগড়ে গেলেও ঘটনার সত্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই। ঐ সব মুসলমানরা যে ইসলামকে পরিত্যাগ করেছিল তা নয়,বরং ইমাম হোসাইনের (আ.) প্রতি তাদের ভক্তির অভাব ছিল তারও কোনো প্রমাণ মেলে না। কারণ,ইমাম হোসাইনের (আ.) প্রতি বীতশ্রদ্ধ হলে তারা হয়তো বলতে পারতো যে,(নাউযুবিল্লাহ) ইমাম হোসাইন (আ.) ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে গেছেন। সুতরাং তাকে হত্যা করতে কোনো বাধা নেই। বরং তারা নিশ্চিতভাবে ইয়াযিদের ওপর ইমাম হোসাইনের (আ.) সহস্র গুণে শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদায় বিশ্বাস করতো। তাহলে এখন প্রশ্ন হল যে,প্রথমতঃ কিভাবে মুসলিম শাসন ক্ষমতা ইসলামের ঘোরশত্রু আবু সুফিয়ানের দলের হাতে পড়লো? দ্বিতীয়তঃ যে মুসলমানরা ইমাম হোসাইনের (আ.) রক্তের মূল্য যথার্থভাবে অবগত ছিল তারা কিভাবে ইমাম হোসাইনকে (আ.) হত্যা করলো?

প্রথম প্রশ্নের জবাবে বলতে হয় যে,উমাইয়াদের মধ্যে প্রথমভাগে মুসলমান হবার গৌরব অর্জন করেছিল এবং ইসলামের প্রতি কোনো বিদ্বেষ পোষণ করতো না,বরং ইসলামের জন্যে অনেক অবদানই রেখেছিল এমন ব্যক্তির (অর্থাৎ ওসমানের) খলীফা পদ লাভই ছিল এর মূল কারণ। এর ফলেই উমাইয়ারা সর্ব প্রথম মুসলিম খেলাফত লাভ করার সুযোগ পায়। আর,এ সুযোগকে ব্যাবহারকরে তারা ইসলামী শাসন ব্যাবস্থাকে নিজেদের মুলুকে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিল। স্বয়ং মারওয়ানই এর জলন্ত উদাহরণ। অবশ্য হযরত ওমরের শাসনামলেই মোয়াবিয়াকে শাম বা সিরিয়ার গভর্ণর হিসেবে নিযুক্তির মাধ্যমেইসলামী শাসনযন্ত্রে উমাইয়াদের উত্থান ঘটে। পরবর্তিতে অন্য সব গভর্ণরের পদে রদবদল করা হলেও মোয়াবিয়াকে তার পদে বহাল রাখা হয়। এটাই ছিল মুসলিম শাসন ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার মাধ্যমে উমাইয়াদের হীন বাসনা চরিতার্থ করণের পথে প্রথম অনুকূল ইঙ্গিত।

উমাইয়ারা হযরত ওসমানের শাসন ব্যবস্থায় দুর্নীতি ছড়ায় ও গোলযোগ সৃষ্টি করে। এতে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং শেষ পর্যন্ত মোয়াবিয়া তার সে লালসা পুরণের জন্য মোক্ষম সুযোগ পেয়ে গেল। সে নিজের পক্ষ থেকে ওসমানকে মজলুম খলীফা , শহীদ খলীফা প্রভৃতি সুবিধামত স্লোগান দিয়ে প্রচারকার্য শুরু করলো এবং স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করতে আদাজল খেয়ে লেগে গেল। সন্দেহযরত ওসমানের রক্তভেজা জামা সবার সামনে মেলে ধরে তার মজলুমস্তকে গতিশীল রূপ দেয় এবং বলে বেড়ায়, যেহেতু ওসমানের হত্যার পর আলী (আ.) খলীফা হয়েছেন,তাছাড়া ওসমানের হত্যাকারীদেরকে তিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন-সুতরাং ওসমান হত্যার জন্য মূলতঃ আলীই (আ.) দায়ী। এই বলে সে ভেউ ভেউ করে কাদতে থাকে যাতে মানুষের অনুভূতিকে আকৃষ্ট করতে পারে। তার এ প্রচেষ্টা সফলও হয়। কারণ,তার কান্নার সাথে সুর মিলিয়ে অনেকেই চোখের পানি ঝরায় ও শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে মজলুম খলীফার রক্তের প্রতিশোধ নিতে যেই কথা-সেই কাজ-এই রুপে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। তারা মোয়াবিয়াকে আশ্বাস দেয়ঃ আমরা প্রস্তুত আছি,তুমি যা বলবে তাই আমরা পালন করতে রাজী আছি। এভাবে পদলোভী স্বার্থপর মোয়াবিয়া স্বয়ং মুসলমানদেরকে নিয়েই ইসলামের বিরুদ্ধে বিশাল সেনাবাহিনী গড়ে তোলে।

সম্পর্কযুক্ত পোস্ট

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Are you sure want to unlock this post?
Unlock left : 0
Are you sure want to cancel subscription?