বন্দী কাফেলা পথ চলতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে কারবালার সাথে দূরত্ব বেড়ে চলেছে। একবার বিবি যয়নাব ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.)-এর অবস্থার উপর দৃষ্টিপাত করেন এবং বুঝতে পারেন যে, তিনি উটের পৃষ্ঠে প্রাণ যায় যায় অবস্থায় আছেন। তৎক্ষণাৎ তিনি তাঁর নিকট যান এবং এ অবস্থার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। কারণ জানার পর ভাইয়ের রেখে যাওয়া এ স্মৃতিকে সান্তনা দিতে শুরু করেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সা.) ও আলীর (আ.) কথাগুলো বর্ণনা করেন যা খুবই লক্ষণীয় এবং গভীর চিন্তার অবকাশ থাকে।
ইমাম যয়নুল আবেদীন (আ.) এই ঘটনাটি এভাবে বর্ণনা করেন:
-“যখন কারবালায় আমাদের উপর ঐ ধরনের বিপদ আসল ও আমার পিতা শহীদ হয়ে গেলেন এবং তাঁর সব সন্তান ও ভাই এবং পরিবারের প্রায় সবাই যারা তাঁর সাথে ছিলেন শহীদ হয়ে গেলেন আর তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারকে খালি উটের পিঠে বসিয়ে কুফা নগরীর দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন আমি শহীদদের লাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। দেখলাম যে, তারা মাটির উপর পড়ে আছে, কেউ তাদের দাফনের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি।
এই দৃশ্য আমার নিকট অত্যন্ত পীড়াদায়ক ছিল যা আমার বুকে আঘাত হানে এবং আমাকে অস্থির করে তোলে। অবস্থা এমন পর্যায়ে ছিল যেন আমার প্রাণ যায় যায়!
আমার ফুফু যয়নাব বিনতে আলী (আ.) আমার এ অস্থির অবস্থা দেখে আমার নিকট আসলেন ও বললেন:
-তোমার এ-কি অবস্থা দেখছি! হে আমার নানা রাসূলের (সা.), পিতা আমিরুল মুমিনীন আলী ও ভাই হাসানের স্মৃতি! কি হয়েছে তোমার, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন প্রাণ বিসর্জন দিতে চলেছ?!
আমি বললাম: এটা কিভাবে হতে পারে যে, আমি পেরেশান ও অস্থির হব না যখন আমি দেখছি যে, আমার পিতা হোসাইন, আমার অন্যান্য ভাই, চাচা, চাচাতো ভাই ও আমাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা মাটির উপরে পড়ে আছে আর নিজেদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে, তাদের শরীর থেকে পোশাক ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং তাদের লাশগুলো বিবস্ত্র অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। কেউ তাদের কাফন-দাফনের চিন্তাও করছে না। এমন কি কোন ব্যক্তি তাদের ধারে কাছেও যাচ্ছে না. ঠিক যেন কোন কাফেরের লাশের পাশ দিয়ে ভ্রুক্ষেপ না করেই সবাই চলে যাচ্ছে! (এমনভাবে যাচ্ছে যেন তাদেরকে মুসলমানই মনে করে না!)
-তখন (ফুফু যয়নাব) বললেন: এ সব দৃশ্য যেন তোমার কষ্টের কারণ না হয়। আল্লাহর কসম! আজ যা ঘটেছে তার সবকিছুই রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এর পক্ষ থেকে আমিরুল মুমিনীন আলী, ইমাম হাসান মুজতবা ও তোমার পিতা হোসাইনকে খবর দেওয়া হয়েছে। (যা কিছু ঘটেছে একটা ঐশী পরিকল্পনার আওতায় ঘটেছে)। তাছাড়া আল্লাহ্ একদল মানুষের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন, যাদেরকে জমিনের অত্যাচারী লোকেরা চিনে না, কিন্তু আসমানে তারা সুপরিচিত, এই অঙ্গীকার যে, কারবালার মরুভ‚মিতে উপস্থিত থেকে শহীদদের পবিত্র দেহগুলো একত্রিত করে রক্তে রঞ্জিত লাশগুলো দাফন করবে। তারা এই স্থানে সাইয়্যেদুশ শোহাদা’র (ইমাম হোসাইনের) কবরে একটি চিহ্ন স্থাপন করে দিবে যার প্রভাব কখনোই হবে না ও সেটাকে কোনদিন নিশ্চিহ্ন করাও সম্ভব হবে না। যদিও কুফরি, নাস্তিকতা ও পথভ্রষ্টদের নেতৃবৃন্দ ঐ পবিত্র হেরেমকে ধ্বংস করার অনেক চেষ্টা করবে। কিন্তু কোন ফল হবে না। ঐ হেরেমকে ধ্বংস করার পরিবর্তে বরং তার মহিমা ও জৌলুস দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাবে এবং তার প্রভাবসমূহ আরো প্রকাশ্য হয়ে উঠবে।
-আমি বললাম: সে অঙ্গীকারটি কি ছিল? আর সে খবরটাই বা কি ছিল?
হযরত যয়নাব উত্তরে বললেন: উম্মে আয়মান আমাকে বলেছেন যে, একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাঁর কন্যা ফাতিমা’র ঘরে আসলেন। ফাতিমা পিতার আপ্যায়নের জন্য খাদ্য প্রস্তুত করলেন আর আমিরুল মুমিনীন আলী একটি পাত্রে খেজুর নিয়ে আসলেন এবং আমিও কিছু পরিমাণ দুধ ও দুধের সর তাঁর সামনে পরিবেশন করলাম।
খাবার খাওয়ার পর আমিরুল মুমিনীন আলী পানি আনলেন ও তা দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) হাত ধৌত করলেন। তারপর তাঁর কন্যা ফাতিমা, আলী, হাসান ও হোসাইনের দিকে মমতাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন যা অশেষ খুশির বহিঃপ্রকাশ ছিল ও তাঁর চেহারায় পরম আনন্দের ছাপ ছিল দেখার মত। অতঃপর তিনি আসমানের দিকে তাকালেন ও কিবলামুখী হলেন এবং হাতগুলি আসমানের দিকে উঁচু করে তুলে ধরে দোয়া করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর চক্ষুদ্বয় অশ্রুসজল হয়ে গেল ও তিনি সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন এবং আরো উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। তাঁর সিজদা অনেক দীর্ঘায়িত হল, তাঁর স্কন্ধ যেন উঁচু-নীচু হচ্ছিল ও অশ্রুফোঁটা অঝোরে ঝরে পড়ছিল। যখন তিনি সিজদা থেকে মাথা ওঠালেন তখন তাঁর অবস্থা এমন ছিল যেন তাঁর মুখমন্ডলে বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছে। তিনি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে ঘরের এক কোণে বসেছিলেন।
রাসূলুল্লাহর (সা.) ক্রন্দনে পরিবারের সবাই দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ভাবলেশ এতটাই ভারী ছিল যে, তাঁকে প্রশ্ন করা সম্ভব ছিল না। কারো সাহস হচ্ছিল না যে, তাঁর ক্রন্দনের ব্যাপারে তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে। তাঁর দীর্ঘক্ষণ ক্রন্দনের পর আলী ও ফাতিমা বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কাঁদছেন কেন? আল্লাহ্ যেন কখনোই আপনার চোখের অশ্রæ না ঝরায়, আপনার কান্নায় আমাদের অন্তরে আগুন ধরে যায়, কি এমন বিষয় আপনার কান্নার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে?!
-রাসূলুল্লাহ্ (সা.) আমিরুল মুমিনীন আলীকে (আ.) উদ্দেশ্য করে বলেন: হে আমার ভাই। তোমাদেরকে দেখার পর আমি অত্যন্ত খুশি ও আনন্দিত হয়ে পড়েছিলাম। এমন আনন্দিত হয়েছিলাম যে, ইতিপূর্বে কোনদিন এত আনন্দিত হইনি। আমি তোমাদের দিকে তাকিয়ে আল্লাহর এই সব নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করছিলাম। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই জিব্রাইল অবতীর্ণ হন এবং এভাবে বলেন: হে মুহাম্মাদ! আপনার অন্তরে এখন যা ভাবছেন আল্লাহ সে সম্পর্কে অবগত আছেন এবং দেখছেন যে, আপনি আপনার ভাই আলী, ফাতিমা, হাসান, হোসাইনের মাধ্যমে কতটা খুশি ও আনন্দিত হয়েছেন। তাই তিনি তাঁর অনুগ্রহকে এভাবে পরিপূর্ণ করেছেন ও তাঁর উপঢৌকন পাঠিয়েছেন যে, তাঁরা, তাঁদের বংশধরগণ, সঙ্গী-সাথীগণ ও তাঁদের অনুসারীগণ বেহেশতে আপনার পাশে থাকবে, এমন অবস্থায় থাকবে যে তাঁদের ও আপনার মাঝে কোন ব্যবধান থাকবে না। তিনি তাদেরকেও তাঁর অফুরন্ত নিয়ামত দিবেন যেভাবে আপনাকে দেওয়া হবে, তাদেরকেও ঐভাবেই দান করা হবে যেভাবে আপনাকে দান করা হবে আর তাতে তারা অত্যন্ত সন্তুষ্ট ও খুশি থাকবে এবং আপনার উপর সন্তুষ্টির কারণে তিনি তাঁর অনুগ্রহ আরো বৃদ্ধি করে দিবেন।
আল্লাহর এই দয়া ও অনুগ্রহের বিপরীতে কিছু কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে যা আপনার আহলে বাইতের নিকট থেকে নেওয়া হবে। পরীক্ষাটি হল কিছু অপ্রিয় বিপদকে বরণ করা এবং এমন একদল লোকের দ্বারা সে পরীক্ষা নেওয়া হবে যারা নিজেদেরকে আপনার উম্মত বলে দাবী করবে (প্রকৃতপক্ষে তারা আল্লাহ ও আপনার থেকে অনেক দূরে)।
এই সব লোকেরা তাদের উপর অত্যন্ত কঠিন ও অসহ্য জুলুম চালাবে। তাদের মধ্যে অনেকেই নিহত হবে আর তাদের নিহতের স্থানগুলি থাকবে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে এবং তাদের মাজারগুলি হবে পরস্পর থেকে দূরে দূরে। এসব ঘটনাকে আল্লাহ্ আপনার ও আপনার আহলে বাইতের পরীক্ষাস্বরূপ নির্বাচিত করেছেন। অতএব আপনি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করুন এবং তাঁর নির্দেশের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন।
আমিও আল্লাহর প্রশংসা করি ও তাঁর নির্দেশের ক্ষেত্রে যা তিনি আপনার ও আপনার আহলে বাইতের ওপর আরোপ করেছেন তাতে সন্তুষ্ট আছি।
-অতঃপর জিব্রাইল (আ.) আমাকে বললেন: হে মুহাম্মাদ! আপনার পরে আপনার ভাই আলী (আ.) আপনার উম্মতের দ্বারা কষ্টের শিকার হবে ও অনেক অত্যাচার সহ্য করবে। আপনার শত্রæদের দেওয়া প্রচÐ যন্ত্রণা মুখ বুজে সহ্য করবে এবং অত্যন্ত জঘন্য ও নির্দয় ব্যক্তির হাতে নিহত হবে। তাঁর হত্যাকারীর দুরাবস্থা হবে ঠিক হযরত সালেহ’র উটনী হত্যাকারীর ন্যায়।
আপনার ভাই আলী’র (আ.) শাহাদাত এমন এক শহরে ঘটবে যে শহরে সে নিজে হিজরত করে যাবে আর ঐ শহরটি তার শিয়াদের গোড়াপত্তন ও তার সন্তানদের বসবাস ও বেড়ে উঠার স্থান হবে। কিন্তু সেই শহরেই তাদের বালা-মুসিবত অনেকগুণ বেশী হবে। এ পর্যায়ে জিব্রাইল হোসাইনের দিকে ইশারা করে বলেন ।
আপনার এই সন্তান আপনারই পরিবারের কিছু লোকজনকে নিয়ে এবং আপনারই উম্মতের একদল উত্তম মানুষকে নিয়ে ফোরাতের তীরে শাহাদাত বরণ করবে, যে স্থানটির নাম কারবালা।
ঐ মহা ঘটনার পারলৌকিক ফলাফল হবে এটা যে, কিয়ামতের দিন- যেখানে দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই ও যেখানে অনুতাপ, অনুশোচনার অন্ত নেই- সেদিন সকল প্রকার দুঃখ-দুর্দশা আপনার শত্রæদের ও আপনার সন্তানবর্গের শত্রুদেরকে ঘিরে ধরবে।
তবে কারবালা এই জমিনের ওপরে সবচেয়ে পবিত্রতম ভ‚মি এবং অত্যন্ত মর্যাদার অধিকারী। আপনার সন্তান হোসাইন ও তার পরিবারবর্গ সেখানে শহীদ হবে, আর ঐ শাহাদতের স্থানটি হল বেহেশতের একটি টুকরা।
কাফেররা যখন হোসাইন (আ.) ও তার পরিবারবর্গকে চারিদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলবে, আল্লাহর রহমত বঞ্চিত লোকেরা তাদেরকে স্বীয় আয়ত্তের মধ্যে রাখবে, তাদের নিজেদের গুপ্ত আক্রোশকে তাদের উপর নিক্ষেপ করবে, প্রতিশোধপরায়ন হয়ে তাদেরকে হত্যা করতে উদ্যত হবে, এমতাবস্থায় আপনাকে অসম্মান ও অপমান করার কারণে এবং আপনার পরিবারবর্গের উপর যে জুলুম-অত্যাচার করা হবে তার কারণে পৃথিবী কেঁপে উঠবে, পাহাড়সমূহ অস্থির হয়ে উঠবে, সমূদ্র উত্তাল হবে এবং আসমানবাসীরা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়বে, আর প্রত্যেকেই আল্লাহর নিকট অনুমতি প্রার্থনা করবে এই জন্যে যে, যাতে আপনার পরিবারবর্গ যারা এই সৃষ্টি জগতে আল্লাহ্র হুজ্জাত (অকাট্ট প্রমাণ), যারা নির্যাতিত ও হীনবল, তাদেরকে সাহায্য করতে পারে। তখন আল্লাহ্ তাদের উত্তর দিবেন: আমি স্বয়ং আল্লাহ্ এমন পরাক্রমশালী শাসক যে, এমন কোন ব্যক্তি নেই যে আমার ক্ষমতার বাইরে যেতে পারে, কোন শত্রুরই ঐ ক্ষমতা নেই যে আমাকে অক্ষম ও পরাস্ত করবে, আমি আমার বন্ধুদের সাহায্য ও শত্রুদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণে যথেষ্ট। আমার ইজ্জতের কসম! যারা আমার রাসূলকে একা ফেলে চলে যাবে ও তাঁকে অসম্মান করবে, তাঁর সন্তানদেরকে হত্যা করবে, তাঁর আমানতগুলোকে পদদলিত করবে, তাঁর পরিবারবর্গের উপর অত্যাচার করবে, আমি তাদের এমন শাস্তির ব্যবস্থা করবো যে শাস্তি কখনো কোন সৃষ্টির জন্য ব্যবস্থা করিনি।
এসময়ে আল্লাহ এ উত্তর শোনার পর আসমান ও জমিনের সকল বস্তু, যারা যারা আপনার পরিবারের উপর অত্যাচার ও নির্যাতন চালানোর ধৃষ্টতা প্রদর্শন করবে তাদের উপর অভিশাপ বর্ষণ করতে থাকবে।
-যখন কারবালার শহীদগণ রণাঙ্গণে যাবেন, স্বয়ং আল্লাহ তাঁদের রূহ কবজের দায়িত্ব নিবেন। মহীয়ান আল্লাহ সপ্তম আসমান হতে তাঁদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য এমন কিছু ফেরেশতা অবতীর্ণ করবেন যাদের হাতে ইয়াকুত ও পান্না পাথরের তৈরী পাত্র থাকবে যা আবে হায়াত (অমৃত সুধা) দ্বারা পরিপূর্ণ। তারা নিজেদের সাথে বেহেশতী পোশাক ও সুগন্ধি নিয়ে আসবেন। তারা আবে হায়াত দ্বারা শহীদদেরকে গোসল করাবেন ও বেহেশতী পোশাক পরিধান করাবেন এবং বেহেশতী সুগন্ধি মাখিয়ে দিবেন আর দলে দলে ফেরেশতা শহীদদের জানাযা’র নামাজ আদায় করবেন।
অতঃপর মহান আল্লাহ্ আপনার উম্মতের মধ্য হতে একদলকে যাদের হাত শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয়নি, যারা তাঁদের নিহত হওয়ার ঘটনার সাথে কোনভাবেই জড়িত নয় এমনকি না কথা-বার্তায়, না আচার-আচরণে আর না নিয়্যতে অবশ্য তারা পূর্বশত্রæ হিসেবেও গণ্য হবে না এমন একটি দলকে অতিদ্রæত প্রেরণ করবেন যেন তারা শহীদদের লাশগুলোকে দাফন করেন ও সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হোসাইনের (আ.) কবরের উপর একটি হেরেম তথা মাজার শরীফ তৈরী করে দেন যাতে সঠিক পথের অনুসারীদের জন্য স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থাকে আর ঈমানদারদের জন্য হয়ে থাকে এক পরিত্রাণ স্থল স্বরূপ।
প্রতিদিন এক লক্ষ ফেরেশতাকে নিয়োগ দিবেন যারা আসমান হতে অবতীর্ণ হয়ে সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হোসাইনের (আ.) মাজার তাওয়াফ করবে, তাঁর উপর দরুদ ও সালাম পাঠ করবে এবং আল্লাহর গুণগান করবে। তারা সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হোসাইনের (আ.) জিয়ারতকারীদের জন্য ইস্তেগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা করবেন এবং যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে তাঁর জিয়ারত করতে আসবে তাদের নাম ও বৈশিষ্ট্যসমূহ পরিপূর্ণভাবে লিপিবদ্ধ করবে। আর ঐ কলম যে কলম আল্লাহ্ আরশের নূর দ্বারা তৈরী তা দিয়ে প্রত্যেক জিয়ারতকারীর চেহারায় এই কথাটি খোদাই করে লিখে দিবে যে, “এই ব্যক্তি সর্বোত্তম শহীদ ও সর্বোত্তম নবীর সন্তানের জিয়ারতকারী”। কিয়ামত দিবসে তাদেরকে এই নূর দ্বারা সনাক্ত করা হবে এবং এই নূর তাদের চেহারায় উজ্জ্বল হয়ে ফুটে থাকবে যা দেখে সবাই হতবাক হবে।
ঐদিন আপনি, হে মুহাম্মাদ। আমার ও মিকাঈলের মাঝখানে থাকবেন আর আলী আমাদের অগ্রগামী হবেন এবং অসংখ্যফেরেশতা আমাদের সাথে রওয়ানা হবেন। আমরা ঐ নূরের মাধ্যমে যে নূর তাদের চেহারায় অঙ্কিত আছে সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হোসাইনের (আ.) জিয়ারতকারী হিসেবে সনাক্ত করবো ও লোকদের মধ্য হতে আলাদা করবো। এভাবেই আল্লাহ তাদেরকে কিয়ামত দিবসের ভয়-ভীতি ও কঠিন শাস্তি হতে মুক্তি দিবেন। এটা ঐ সকল ব্যক্তিদের উপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ যারা আপনার কবর হে মুহাম্মাদ! ও আপনার ভাই আলী’র কবর অথবা আপনার দুই সন্তান হাসান ও হোসাইনের কবর বিশুদ্ধ নিয়্যতে শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জিয়ারত করবেন।
অবশ্য মানুষের মধ্যে একদল থাকবে যারা আল্লাহর অভিশাপ ও ক্রোধের শিকার তারা অনেক চেষ্টা করবে সাইয়্যেদুশ শোহাদা ইমাম হোসাইনের (আ.) স্মৃতিচিহ্নকে মুছে ফেলতে, এ ক্ষেত্রে তারা সবধরণের প্রচেষ্টা চালাবে। কিন্তু মহান আল্লাহ্ তাদেরকে এ ধরনের কোন ক্ষমতা-ই প্রদান করবেন না!
অতঃপর রাসূল (সা.) বললেন: জিব্রাইলের এই কথাগুলো শুনে আমি দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়েছিলাম তাই কান্নাকাটি করছিলাম।
-হযরত যয়নাব কুবরা (সা.আ.) এই ঘটনা বর্ণনার পাশাপাশি আরো বলেন: যখন আমার পিতা ইবনে মুলজিম-এর তরবারির আঘাতে আহত হন এবং তাঁর চেহারায় মৃত্যুর চিহ্ন দেখতে পেলাম তখন আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলামঃ হে বাবা! ‘উম্মে আয়মান’ আমার নিকট যে বিষয়টি বর্ণনা করেছেন আমি চাই সে বিষয়টি আপনার মুখ থেকে শুনবো।
আমার পিতা বললেন: ঘটনাটি ঠিক ঐ রকমই যেমনভাবে ‘উম্মে আয়মান’ বর্ণনা করেছেন। যেন আমি দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি ও তোমার সঙ্গী নারীরা এই কুফা শহরে প্রবেশ করছো ও বন্দিদশার কারণে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। আর প্রতিটি মুহূর্তে এই ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত আছ যে, এই বুঝি মানুষের পায়ের নীচে পড়ে পদদলিত হব! অতএব তুমি অত্যন্ত ধৈর্য্য ও সাহস রাখবে আর আত্মরক্ষা করবে। ঐ আল্লাহর কসম যিনি শস্যদানার ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়েছেন এবং মানুষকে সৃষ্টি করেছেন! ঐদিন তোমরা ও তোমাদের বন্ধুরা এবং তোমাদের অনুসারীগণ ব্যতিত পৃথিবীতে আর কেউ আল্লাহর ওলি থাকবে না।
যখন আল্লাহর রাসূল (সা.) এই সংবাদটি আমাদের নিকট বর্ণনা করছিলেন তখন আরো বলেছিলেন: ঐদিন ইবলিস আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়বে ও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা হতে তার অনুগত অন্যান্য শয়তানদেরকে একত্র করে বলবে: হে শয়তান দল! আজ আমরা আদম সন্তানের কাছ থেকে আমাদের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পেরেছি। তার ধ্বংস হওয়াতে আমাদের আশা-আকাঙ্খা পূর্ণ হয়েছে, জাহান্নামের আগুন তার কপালে দিয়েছি। কিন্তু যারা এই দলে (নবী পরিবার) যোগ দিবে, তোমরা চেষ্টা করবে তাদের মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় সৃষ্টি করার এবং জনগণকে উৎসাহ যোগাবে যাতে তারা তাদের সাথে শত্রুতা করে। ফলে তারা তাদেরকে কাফের হিসেবে সাব্যস্ত করবে এবং আর মুক্তির কোন পথ খুঁজে না পায়! যদিও ইবলিস প্রচÐ মিথ্যাবাদী, তারপরেও সে অন্যান্য শয়তানদেরকে এই কথাটি সত্য বলেছে যে, যদি কেউ তোমাদের (নবী পরিবারের) সাথে শত্রæতা করে তাহলে তার কোন আমলই তাকে রক্ষা করতে পারবে না। অপরদিকে যদি কেউ তোমাদের কর্তৃত্বকে মেনে নেয় ও তোমাদের প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করে তাহলে তার কবিরা গুনাহ ব্যতিত অন্য কোন কিছুই তার কোন ক্ষতিসাধন করতে পারবে না।
লক্ষণীয় বিষয়: এই নূরানী হাদিসটি এতটাই গভীর বিষয়বস্তুতে পরিপূর্ণ এবং তাৎপর্যমÐিত যে, তার ব্যাখ্যার জন্য একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করার দরকার। এই অল্প পরিসরে এই হাদিসের মর্মার্থ সম্পূর্ণভাবে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। তাই শুধুমাত্র হাদিসটি উল্লেখ করেই ক্ষান্ত থাকছি