কেন আলী (আ.) ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) হত্যার প্রতিশোধ নেননি?

অনুবাদ: মল্লিক শিহাব ইকবাল

by Syed Yesin Mehedi

নিপীড়ন এবং সমর্থনের অভাবের মুখে ধৈর্য্য ধারণ করার জন্য হযরত আলী (আ.) মহানবী (সা.)-এর নির্দেশের ভিত্তিতে প্রতিশোধ নেননি। তিনি (আ.) আপাতদৃষ্টিতে ব্যক্তিগত অভিযোগের প্রতিশোধ নেওয়ার পরিবর্তে ইসলামে দলাদলি এড়াতে এবং মুনাফিকদের শীর্ষস্থান অর্জন থেকে বিরত রাখার উপর উচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন।
এছাড়াও, প্রতিশোধ নেওয়া আরব জাহিলিয়াতের বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে অন্যতম। ইসলাম যতটা সম্ভব ধৈর্য ও সহনশীলতার প্রচার করে, নিপীড়িতদের জন্য আরও বেশি পুরষ্কার এবং অত্যাচারীর জন্য আরও শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে।
এর অর্থ হল নিপীড়ন যত দীর্ঘায়িত হবে, নির্যাতিত ও নিপীড়কের জন্য যথাক্রমে পুরষ্কার ও শাস্তি তত বেশি হবে। প্রতিশোধ না নেওয়ার মাধ্যমে হযরত আলী (আ.) এবং ফাতিমা যাহরা (সা.আ.) আজ পর্যন্ত নির্যাতিত হচ্ছেন এবং প্রতিনিয়ত পুরস্কৃত হচ্ছেন এবং তাদের অত্যাচারীরাও একইভাবে অব্যাহতভাবে শাস্তি পাচেছ। পবিত্র কুরআন ছিল আহলে বাইত (আ.)-এর পথপ্রদর্শকের আলো। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে ঃ “তুমি যদি প্রতিশোধ গ্রহণ কর, তবে তুমি যা ভোগ করেছ তার সমতুল্য হতে দাও। কিন্তু যদি তোমরা ধৈর্য্য ধর, তবে অবশ্যই তা ধৈর্যশীলদের জন্য উত্তম।” (সুরা নাহল: ১২৬)
এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যখন মহানবী (সা.) একইভাবে গুরুতর অপরাধের প্রতিশোধ নেননি।
(১) হামজার হত্যাকারী ওয়াহশীকে নবী (সা.) শাস্তি দেননি। মুয়াবিয়া ইবনে মুগীরা ইবনে আবিল আস, যে হামজার মৃতদেহ অপবিত্র করেছিল, নবী (সা.) তাকে মদিনা ত্যাগ করার জন্য তিনদিন সময় দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.) এর জন্য ওয়াহশী বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া উচিত ছিল স্বাভাবিক, যিনি তাঁর প্রিয় চাচার বিকৃত মৃতদেহ দেখে ভয়ঙ্করভাবে বিচলিত হয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ সেই পর্যায়ে আয়াতটি নাজিল করার পর তিনি ধৈর্য ধরলেন; আর যদি আপনি প্রতিশোধ গ্রহণ করেন তবে আপনি যে কষ্ট পেয়েছেন সেই পরিমাণ প্রতিশোধ নাও। কিন্তু যদি তোমরা ধৈর্যধারণ কর, তবে অবশ্যই তা ধৈর্যশীলদের জন্য উত্তম হবে। (সুরা নাহল: ১২৬)
(২) খালিদ ইবনে ওয়ালিদ জাহিলিয়াতের যুগের পুরানো শত্রুতার কারণে নতুন ধর্মান্তরিত মুসলমানদের একটি গোত্র (বনি জাজিমা) নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন। নবী (সা.) খালিদকে শাস্তি না দিয়ে বারবার খালিদের কর্ম থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। নবী (সা.) আলী (আ.)কে পাঠিয়ে রক্তের মূল্য দিয়ে বিষয়টি মিমাংসা করেন। (সহীহ বুখারী বই ৬৪, ট্রেড ৩৬৮)
(৩) আকাবাহ’র ঘটনায় মহানবী (সা.) এক ডজনেরও বেশি মুনাফিকের কাছ থেকে মারাত্মক আক্রমণের সম্মুখীন হন। মহানবী (সা.) শুধু তাদেরকে পালিয়ে যেতে দেননি, তিনি প্রকাশ্যে তাদেরকে পরিচয় দিয়ে হুজাইফাকে শনাক্ত করার জন্য সতর্ক করেছিলেন।
ইসলামী সমাজের সমস্যা প্রতিরোধ করার জন্য এটি ছিল পরবর্তী পর্যায়। যখন নবী (সা.)কে বলা হয়েছিল মুনাফিকদের নাম প্রকাশ করতে এবং তাদের শাস্তি দিতে, তখন তিনি (সা.) বলেছেন: আমি পছন্দ করি না যে, মুহাম্মদ সাহাবীদের হাতে হাত মিলিয়ে, ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তাদের নাম দেন। (সুরা তাওবার তাফসীরের অধীনে মাজমা আল বায়ান ৫ম খন্ড পৃষ্ঠা নং ৬৮)
সুতরাং মহানবী (সা.) তাঁর উপর আক্রমণের প্রতিশোধ নেননি। যখন তাঁর সমগ্র সমর্থন এবং তাঁর পিছনে সমগ্র মুসলিম সেনাবাহিনী ছিল তখন এটি আশ্চর্যের কিছু নেই যে, হযরত আলী (আ.) একইভাবে ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর ওপর হামলার প্রতিশোধ নেবেন না। প্রকৃতপক্ষে, প্রতিশোধ না নেওয়াই ছিল আলী (আ.) এর স্বাভাবিক কর্মকান্ড।
(৪) আবু সুফিয়ান, মুয়াবিয়া, আমর আস, যারা বছরের পর বছর ধরে রাসুলুল্লাহ (সা.)কে কষ্ট দিয়েছিল, মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (সা.) তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ পেয়েও শাস্তি দেননি।
অনুরূপভাবে, যারা মহানবী (সা.) এর সুন্নাতের প্রতি উপেক্ষা করেছেন এবং একই কারণে ধর্মের মধ্যে বিরোধ এড়াতে আহলে বাইত (আ.) প্রতিশোধ নেননি।
ধৈর্যের কারণে আল্লাহর বৃহত্তর পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি:
(১) জামালের যুদ্ধে আলী (আ.) মারওয়ানকে বন্দী অবস্থায় রক্ষা করেছিলেন এবং এমনকি মারওয়ানের আনুগত্যের দাবিও করেননি। ইমাম (আ.) নবীর স্ত্রীকেও সসম্মানে মদিনায় ফেরত পাঠান। তৎকালীন খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শাস্তি মৃত্যুদন্ড হওয়া সত্তে ও হযরত আলী (আ.) তা উপেক্ষা করেছিলেন।
(২) হযরত আলী (আ.) ফাদাক ফিরিয়ে নেননি (যা সংশয়বাদীদের আরেকটি আপত্তি) কারণ ফাতিমা জাহরা ফাদাক থেকে বঞ্চিত হওয়ার সময় পর্যন্ত তিনি নির্যাতিত ছিলেন এবং পুরস্কৃত হচ্ছিলেন।
(৩) এমনকি হযরত আলী (আ.) নিজের হত্যাকারী আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম এর জন্য একটি নিয়ম তৈরী করেছিলেন। যদি তিনি (আ.) মারা যান তবে তাকে একটি আঘাতে হত্যা করতে হবে। যা থেকে বোঝা যায় যে, হযরত আলী (আ.) যদি মারাত্মক আঘাত থেকে বেঁচে থাকতেন তবে তিনি আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিমকে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টি উপেক্ষা করতেন। এছাড়াও, তিনি (আ.) জোর দিয়েছিলেন যে, আব্দুর রহমানের দেহ বিকৃত করা না হয়।
(৪) ইমাম হাসান (আ.) এর পবিত্র দেহের (জানাজার) প্রতি তীর দিয়ে আক্রমণ করার জন্য ইমাম হোসেন (আ.) মারওয়ান ওতদ্বীয় উস্কানী দাতার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেননি।
এই সমস্ত উদাহরণগুলো স্পষ্ট করে যে, প্রতিশোধ না নেওয়াই ছিল মহানবী (সা.) এবং আহলে বাইত (আ.)-এর আদর্শ এবং ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)-এর হত্যার কোন প্রতিশোধ না নেওয়ার অর্থ এই নয় যে, কোন আক্রমণ পরিচালিত হয়নি।

সম্পর্কযুক্ত পোস্ট

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Are you sure want to unlock this post?
Unlock left : 0
Are you sure want to cancel subscription?