বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
ভূমিকা:
শাব্দিকভাবে: ‘ঈদ’ এক আরবী শব্দ যা ‘নাসারা-ইয়ানসুরু’র ওজনে ‘আ-দা (আওয়াদা) ইয়াঊদু’ হতে এসেছে এবং এটি সোলাসী মোর্জারাদের একটি বাব। আর এটি একটি ‘ইসমে মুশ্তাক’ অর্থাৎ ক্রিয়াপদ হতে সৃষ্ট একটি বিশেষ্য; এর অর্থ: কোনো কিছুর পুনরাবৃত্তি ঘটা – চাই তা ভালোই হোক কিংবা মন্দ।
আর পারিভাষিকভাবে: আনন্দ ও খুশির পুনরাবৃত্তিকে ঈদ বলে। কাজেই এটি শুধু ইসলামী অনুষ্ঠানাদিকেই বুঝায় না; বরং যে কোনো ধরনের আনন্দ ও খুশির পুনরাবৃত্তিকেই শামিল করে, যেমন কোনো দেশের স্বাধীনতা বার্ষিকী পালন – ইত্যাদি।
আর ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ (সা.) – এর অর্থ: নবীর (সা.) জন্মদিবসের আনন্দ পালন। অপর ভাষায়: নবীর (সা.) জন্মদিবসকে কেন্দ্র করে খুশি ও আনন্দ উদযাপন করা – ইত্যাদি।
রসুলের (সা.) জন্মতারিখ:
তৎকালে লিখনির তেমন প্রচলন না থাকা সহ আরও অন্যান্য কারণে রসুলের (সা.) জন্মতারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও সুন্নী মতে ১২ এবং শিয়া মতে ১৭ই রবিউল আওয়াল প্রাধান্য পেয়েছে। আর দীর্ঘ সময় ধরেই এই মতপার্থক্য চলে আসছে এবং এটিকে কেন্দ্র করে অনেক সময় অনেক বাক-বিতন্ড ঘটেছে। অনেক মুসলিম ভাই, এটিকে ‘বিদআত’ তথা ইসলামধর্মে নবাবিষ্কার বলে বিপক্ষ দলকে গালমন্দও করে থাকে।
তিনি কোনো একক অঞ্চলের জন্যে আবির্ভূত হননি:
তিনি তৎকালীন হেজায মরুভূমির মক্কা নগরীতে, এক ঘুনে ধরা সমাজে আগমন করে থাকলেও শৈশব, কৈশোর, যৌবন ও যৌবনোর্ধ্ব কালেও ছিলেন সকলের অনুকরণীয় আদর্শ। তিনি একজন মানুষ এবং নবী-রসুল (সা.) হিসেবেও ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ। এ ধুলির ধরায় তাঁর আগমন ঘটেছিল বিশ্বের সকল মানুষের কল্যাণের জন্যে। এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলছেন: “وما أرسناك إلّا رحمة للعالمين.” অর্থাৎ ‘আমরা আপনাকে বিশ্বের জন্যে একমাত্র রহমত বা করুনা হিসেবে প্রেরণ করেছি।” কাজেই তাঁর পয়গাম কোনো একক জাতি ও ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ থাকা উচিত নয় ও হবেও না।
তাঁর ব্যক্তিত্বের মূল্যায়ন:
শ্রেষ্ঠতম মানুষ ও রসুল হযরত মুহাম্মদের (সা.) স্বীকৃতি কেবল পবিত্র কুরআন, হাদীস ও মুসলিম মনীষীদের ভাষ্যের মাধ্যমেই স্বীকৃত নয়; বরং বিশ্বের খ্যাতনামা অমুসলিম ব্যক্তিগণও তাঁকে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকার করেছেন। নিছক একজন ধর্মপ্রচারক হিসেবেই নন, বরং একজন ব্যক্তি মানুষ হিসেবেও অনুপম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, শিষ্টাচার, সত্যনিষ্ঠা, তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, রাষ্ট্র পরিচালনায় অনন্য দক্ষতা, মানবতাবাদী চিন্তাদর্শন এবং পরধর্ম সহিষ্ণুতা – ইত্যাদি মানবীয় গুণাবলির পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে ফরাসি লেখক আলফ্রেড দ্যা ল্যামারটাইন, বীরযোদ্ধা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, পাদ্রি বচওয়ার্থ স্মিথ, স্টিফেন, আলফ্রেড টয়েনবী, ঐতিহাসিক এইচ আর গিবন, থমাস কার্লাইল, জর্জ বার্নার্ড শ, আলবার্ট জনসন প্রমুখ অমুসলিম পাশ্চাত্য মনীষিগণও এই মহান রসুলের (সা.) প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছেন। একইভাবে ভারতীয় উপমহাদেশের স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী, জওহারলাল নেহরু, কবিগুরু রবি ঠাকুর প্রমুখও এই মহানবীর (সা.) শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে একমত পোষণ করেছেন। অনুরূপভাবে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক লেখক মাইকেল এইচ. হার্ট, তার সমগ্র বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ ‘দ্যা হান্ড্রেড’য়ে পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ যে ১০০জন মনীষীর জীবনী তুলে ধরেছেন সেখানে তিনি হযরত মুহাম্মদকে (সা.) শীর্ষতম স্থান দিয়েছেন।
তৎকালে হেজায সহ পৃথিবীর কোত্থাও ব্যাংকিং ব্যবস্থা তথা মানুষের সম্পদ আমানত রাখার কোনো বন্দোবস্ত না থাকায় সমাজের লোকেরা বিশ^স্ত ব্যক্তির তালাশে থাকত। রসুলের (সা.) শৈশবকাল থেকেই মক্কা ও তার আশপাশের লোকেরা তাঁর আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা দেখে তাঁকে ‘আল্ আমীন’ বা বিশস্ত উপাধী দান করেছিল এবং শত্রু-বন্ধু সকলেই, কোনোরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই তাঁর নিকট আমানত রাখত। সমাজের যেসব লোক বিভিন্নভাবে তাঁর ক্ষতি করত, তারাও নিশ্চিত ছিল বা থাকত যে, অন্তত তাঁর পক্ষ হতে তারা কোনো ক্ষতির স্বীকার হবে না! তিনি সশরীরে ২৬/২৭টি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন যার সবই ছিল প্রতিরক্ষামূলক; কিন্তু কোনো যুদ্ধেই তিনি নিজ হাতে অস্ত্র ধারণ করেননি! তায়েফবাসী পাথর নিক্ষেপ করে তাঁর দন্ত মোবারক শহীদ এবং তাঁর মুখমন্ডল রক্তাক্ত করে দিলেও তিনি তাদের জন্যে বদদোয়া তো করেনই নি, বরং তাদের জন্যে আল্লাহর নিকট এমর্মে শাফায়াত করেছেন, “হে আল্লাহ! ওরা আমাকে না চিনে, আমার উপর জুলুম করেছে; কাজেই তুমি ওদের উপর আজাব-গজব দিও না!” এই সীমিত সময়ে আমরা তাঁর গুণাবলি বলে শেষ করতে পারব না। আর তাই কবির ভাষায় বলব: “অপমান তব করিব না আজ করিয়া নান্দী পাঠ।” তবে এতটুকুই বলব যে, তাঁর এসব সৎ গুণের কারণেই তাঁর চরম শত্রুও তাঁর বন্ধুতে পরিণত হত।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি:
বর্তমানে আমরা এক অস্থির-অশান্ত পৃথিবীতে বাস করছি। বিশ্বায়ন এবং তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে সাথে বিশ^ব্যাপী চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। মুসলিম বিশ্ব আজ অনৈক্যের বেড়াজালে আটকে পড়েছে। সামজ্যবাদের কবলে পড়ে ফিলিস্তিনের নিরাপরাধ জনগণ পিষ্ট হচ্ছে। সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান আজ গৃহযুদ্ধের আগুনে দগ্ধ হচ্ছে। ভারতে শত শত মসজিদ-মাদ্রাসা বন্ধ করা ও গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। সামজ্যবাদীদের মদদপুষ্ট হয়ে একদল বিভ্রান্ত লোক ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে মুসলমানদের জঙ্গি হিসেবে পরিচিত করানোর অপচেষ্টা করছে। বিশ্বর বিভিন্ন অঞ্চলে নির্যাতিত হওয়া লোকদের পানে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়ায় আমেরিকার নির্দেশনা ও সহযোগিতায় যায়নবাদী ইসরাঈল ইরানের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে। উত্তর ও দক্ষিণ নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন ও চাদে ‘বোকো হারাম’ নামক আহলে সুন্নতের এক উগ্র-সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে জিইয়ে রেখে সেখানকার জনগণের আরামের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য সহ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই দায়েশ, আল ক্বায়েদা, এস.আই প্রভৃতি উগ্রবাদী সংগঠনের লালন করে অশান্তির দাবানল প্রজ্জ্বলিত রাখা হয়েছে। আর এসব থেকে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও আজ মুক্ত নেই।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায়:
বিশে^র শান্তিপ্রিয় মানুষ উপরোক্ত অবস্থা ও পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চায়। কিন্তু তাদের অনেকেই জানে না কোন্ প্রক্রিয়ায় এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পারে। আবার অনেকেই থিউরি জানলেও তা বাস্তবায়ন করতে অক্ষম। তাই বলছি যে, এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন আমাদের ঐক। ঐকের কোনো বিকল্প নেই। সাধারণ মানুষকে ঐকের উপকারিতা বুঝানোর জন্যে বিভিন্নভাবে উদাহরণ দেয়া হয়: একবার বাঁশের ১০/২০খানা কঞ্চিকে একত্রে আঁটি বেঁধে ভাঙ্গতে বলা হয় এবং আরেকবার আঁটি আলগা করে দিয়ে একখানা কঞ্চিকে ভাঙ্গতে দেয়া হয়। আর এর ফলাফল আমাদের সবারই জানা। আমাদের মানব সমাজও ঠিক তেমনই। সমাজ থেকে, বিশেষত মুসলিম সমাজ থেকে অশান্তি দূরীভূত করার পাশাপাশি বিশ^মঞ্চে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাইলে আমাদের পারস্পরিক ঐক গড়ে তোলার কোনোই বিকল্প নেই।
মুসলমানদের মাঝে ঐক গড়ে তোলার ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে বহু নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যেমন:
“وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ – الخ
وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ وَلَا تَنَٰزَعُواْ فَتَفْشَلُواْ وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ ۖ – الخ
যার অর্থ: আর তোমরা সকলেই আল্লাহর রশিকে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়ো না! স্মরণ কর তোমাদের প্রতি আল্লাহর সেই অনুদানকে যখন তোমরা পরস্পরের শত্রæ ছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের হৃদয়গুলোর মাঝে ভালোবাসা ঢেলে দেন, ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে যাও। আর তোমরা তো এক অগ্নিকুন্ডর ধারে অবস্থান করছিলে, অতঃপর তিনি (আল্লাহ) তোমাদেরকে তা থেকে উদ্ধার করেন। (সূরা: আলে ইমরান/ ১০৩।) আর তোমরা আল্লাহ ও তদীয় রসুলের আনুগত্য কর এবং পরস্পরে ঝগড়া-বিবাদ করো না, আর এরূপ করলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং তোমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। (সূরা: আনফাল/ ৪৬।) এসব আয়াতের সারকথা হচ্ছে এই যে, আমরা ঐকবদ্ধ থাকলে বিশ্বমঞ্চে আমাদের সম্মান বজায় থাকবে, আর পরস্পর বিভক্ত হয়ে পড়লে নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাব।
আল্লাহর রসুলের (সা.) তিরোধানের বহু পরে, ছোটখাটো বিষয়কে কেন্দ্র করে ফকীহদের চিন্তাভাবনার তফাতের কারণে হানাফী, শাফেঈ, মালেকী প্রভৃতি মাযহাবের সৃষ্টি হয়ে থাকলেও মুসলমানদের আল্লাহ এক, রসুল এক, কেবলা এক, কুরআন এক সহ সকল মুসলমানই তকদীরের ভালো-মন্দ, বিচার দিবস, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদিকে একইভাবে বিস্বাস করেন। সকলেই দিন-রাতে পাঁচ ওয়াক্তে ১৭ রাকাত ফরজ নামায আদায় করেন। রমজান মাসে মাস ব্যাপী সিয়াম সাধনা করেন। সারকথা: ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়গুলো যদি একই হয়ে থাকে, তাহলে ছোটখাটো ও গৌণ বিষয়গুলোর তফাতকে এতটা প্রকট করে তোলার কি কোনো কারণ হয়?! আমাদেরকে এসব ছোটখাটো মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে ঐক গড়ে তুলতে হবে। আর তাহলেই আমরা বিশ্বমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ পাব।
ইমাম খোমেইনীর (রহ.) দূরদর্শিতা:
সমসাময়িক বিশ্বর উপরোক্ত ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং মুসলমানদের নাজুক অবস্থা পরিদৃষ্টে হযরত আয়াতুল্লাহ্ আল্ উযমা সাইয়েদ রুহুল্লাহ্ আল্ মুসাভী আল্ খোমেইনী – ইমাম খোমেইনী – (রহ.)’র প্রাণ কেঁদে উঠে। কেননা, তিনি ছিলেন একজন প্রাজ্ঞ দার্শনিক, রাষ্ট্রচিন্তক ও রাজনীতিজ্ঞ, আপোসহীন বিপ্লবী, উঁচুমানের শিক্ষক, হৃদয়স্পর্শী বক্তা এবং সর্বোপরি একজন অনন্য সাধারণ আধ্যাত্মিক নেতা। তাঁর এসব দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার ফলেই তিনি ইরানের আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠিত পাহলাভী রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। কাজেই তিনি উপরোক্ত বিশ^ পরিস্থিতি থেকে মুসলিম সমাজ তথা মুসলিম দুনিয়াকে বের করে আনার উপায় খুঁজা শুরু করেন। মুসলিম বিশ্বর সামনে বিভিন্ন পরিকল্পনাও উপস্থাপন করেন যার একটি হচ্ছে এই “ঈদে মিলাদুন্নবীকে (সা.) কেন্দ্র করে ইসলামী ঐক সপ্তাহ উদযাপন”। তিনি বলেন, আমাদের সুন্নী সমাজ ১২ই রবিউল আওয়াল এবং শিয়া সমাজ ১৭ই রবিউল আওয়ালকে আল্লাহর রসুলের (সা.) জন্মদিবস হিসেবে মেনে নিয়ে নানান কর্মসূচি পালন করে আসছেন। আর এই দুই তারিখের মধ্যে প্রায় এক সপ্তাহের ব্যবধান। তাই এই কয়টি দিনকে আমরা মুসলমানদের কল্যাণ চিন্তায় ব্যয় করতে পারি। তাঁর এই সুচিন্তিত মতামতকে মুসলিম বিশ্বের হিতাকাক্সক্ষী ও ভাবুকশ্রেণী স্বাগত জানিয়েছেন, যার ফলে মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আজ ‘ইসলামী ঐক সপ্তাহ’ পালিত হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ইমামের (রহ.) উপস্থাপিত আরও ২/১টি পরিকল্পনা এখানে স্মরণ করতে বাধ্য হচ্ছি:
:: যুগ যুগ ধরে হজ¦ উদ্দেশ্যে মক্কা-মদীনায় আসা হাজীদের থাকার সুব্যবস্থা ছিল না। বিল্ডিংয়ের অভাব ছিল। টয়লেট-গোসলখানা, ওজুখানা ইত্যাদির অপ্রতুলতা ছিল। আর এসব দেখে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) তৎকালীন সৌদী বাদশাহ ফাহাদকে প্রস্তাব করেছিলেন যে, তিনি যেহেতু হাজীদের থাকা-খাওয়া ইত্যাদির সুব্যবস্থা করতে পারছেন না সেহেতু সেবায় আগ্রহী মুসলিম দেশগুলোর নেতাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে, পর্যায়ক্রমে তাদেরকে যেন হজ¦ মৌসুমে এই মক্কা-মদীনার সেবার সুযোগ দেন! ইমামের এমন প্রস্তাব শুনে বাদশাহ ফাহাদ ভয় পেয়ে যান এবং ইমামের সহযোগিতায় সমস্যাদি ও সমাধানের উপায়সমূহ নির্ণয় করে, সীমিত সময়ের মধ্যেই ব্যাপক মাত্রায় দালান নির্মাণ করে হাজীদের দুর্ভোগ দূরীভূত করার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
:: নিরীহ-নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের উপর যায়নবাদী ইসরাঈলের অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন বন্ধ করার আশা নিয়ে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) বলেছিলেন: “বিশ্বের প্রত্যেক মুসলমান যদি এক বালতি করে পানি ইসরাঈলের মাথার উপর ঢালত তাহলে ইসরাঈল ভেসে যেত!” অর্থাৎ প্রত্যেক মুসলমানই যদি কিঞ্চিত সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে আসত তাহলে ইসরাঈলের অন্যায় করার সাহস আর থাকত না। কিন্তু দুঃখজনক যে, ইরানের এই আহব্বান তেমন কেউ সাড়া দেয়নি। এরপরও ইরান একাই ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে, অথচ ফিলিস্তিনিরা হচ্ছেন সুন্নী এবং ইরানীরা হচ্ছেন শিয়া। তাহলে প্রতীয়মান হয় যে, ইরান, শিয়া-সুন্নীর মাঝে কোনোরূপ বিভেদ সৃষ্টি করে না। সকল মুসলিমকে নিয়েই মুসলমানদের সমস্যার সমাধান করতে চায়।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ:
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ^ব্যাপী মুসলমানদেরকে জালেম পরাশক্তিগুলোর থাবা থেকে মুক্তিদানের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে ক্রমান্বয়ে এগুচ্ছে এবং মুসলমানদের মাঝে ঐক, শান্তি ও সংহতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কিছু বাস্তবমুখি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আর এসব পরিকল্পনার সূচনাকারী ছিলেন মরহুম হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ.) – যার সম্পর্কে ইতিপূর্বে কিছুটা বলা হল – এবং তাঁর ইন্তেকালের পর, তাঁরই সুযোগ্য দ্বীনি উত্তরসূরী হযরত আয়াতুল্লাহ আল্ উযমা সাইয়েদ আলী খামেনেয়ী (হা.) এ ধারা অব্যাহত রেখেছেন।
তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্ব ও পরিচালনায় বর্তমানে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের পক্ষ হতে কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে:
১) প্রতি বছর পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষ্যে ১২-১৭ রবিউল আউয়াল পর্যন্ত মুসলমানদের জন্যে ‘ঐক্য সপ্তাহ’ পালন করা হয়। এ উপলক্ষ্যে ইরানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় যেগুলোতে বিশে^র বিভিন্ন দেশ হতে, বিভিন্ন মাযহাবের স্বনামধন্য চিন্তাবিদগণকে দাওয়াত করা হয়। তাঁদেরকে স্বাধীনভাবে মতামত পেশ করার সুযোগ দেয়া হয় – ইত্যাদি।
২) একইভাবে মুসলমানদের মাঝে পারস্পরিক ঐক গড়ে তোলার লক্ষ্যে “আত্তাকরীব বাইনাল মাযাহেবিল ইসলামিয়াহ” নামে এক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যেখান থেকে বিভিন্ন বই-পুস্তক, ত্রৈমাসিক, ষান্মাসিক পত্রিকা প্রভৃতি প্রকাশিত হয়। আর এসব পত্রিকায় দেশ-বিদেশের জ্ঞানী-গুণীদের মূল্যবান লেখনি প্রকাশিত হয়।
৩) একইভাবে একই উদ্দেশ্যে “মাজমা জাহানী আহলে বাইত (আ.)” নামে অপর এক আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর কার্যক্রম আরও ব্যাপক – যা এখানে তুলে ধরা সম্ভব নয়।
বলাই বাহুল্য যে, ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরান সমগ্র বিশে^র মুসলমানদের নিয়ে ভাবছে। তাদের মাঝে বৃহৎ ঐক গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু এসব কাজে একাই নিবেদিতপ্রাণ হয়ে অর্থ খরচ করে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য একটিই এবং তা হচ্ছে বিশ^মঞ্চে মুসলমানদেরকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুব্যবস্থা করা।
উপসংহার:
আমরা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে যার মাধ্যমে বেশী উপকৃত হই তাকেই বেশি স্মরণ করি। তাহলে যে মহামানব ও মহানবীর (সা.) কারণে আমরা দ্বীন-ইসলাম পেয়েছি তাঁরই আগমনের দিনটি আমাদের নিকট স্বভাবতই অধিকতর গুরুত্ববহ হওয়া উচিত। তিনি আমাদের জীবনকে সহজ-সরল ও সুন্দর করে তুলতে তাঁর আদর্শ রেখে গেছেন। আজকের দিনে আমাদের মাঝে তাঁর আদর্শ চর্চা হওয়া একান্তই প্রয়োজন। কিন্তু আজকের দিনের এসব কর্মসূচী ও অনুষ্ঠানকে যদি আমরা বিদআত আখ্যা দেয়, তাহলে তাঁর জীবনচরিত ও আদর্শ নিয়ে কখন আলোচনা করব এবং সমাজের সাধারণ লোকেরা কখন-কোথা থেকে তা শিখবে?! তাই বলি, রসুলের (সা.) ভালোবাসা ও শাফায়াত লাভের আশায় তাঁর নির্দেশিত পথে চলার পাশাপাশি অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পারস্পরিক সংঘাত, বিভেদ ও অনৈক্য পরিহার করে তাঁর আদর্শের ভিত্তিতে ঐকবদ্ধ একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠাই হোক আমাদের প্রত্যয়। আর আজকের বিশ্ব বাস্তবতায় এটিই ঈদে মিলাদুন্নবীর বড় শিক্ষা হওয়া উচিত।