দ্বীন ইসলামের বিভিন্ন শিক্ষা থেকে শীয়াগণ যে জ্ঞান লাভ করেন তাতে তারা বিশ্বাস করেন, যে বিষয়টি সমাজের সর্বপ্রথম জরুরী তা হল ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সবার এক সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। পবিত্র কুরআন এবং রসুল (সা.) ও তাঁর আহলে বাইত (আ.) জ্ঞানার্জনের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ ও উৎসাহদান করেন। জ্ঞানার্জনের প্রতি অনুপ্রেরণা দিতে গিয়ে মহানবী (সা.) বলেন: জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরজ। (বিহারুল আনওয়ার, ১ম খন্ড, পৃ. ১৭২।) আর পরে সেই শিক্ষাসমূহকে পূর্ণভাবে সমাজে প্রয়োগ করতে হবে। অন্য কথায়:
প্রথমত: সমাজের প্রত্যেককেই এ পৃথিবী ও মানবজাতিকে বাস্তব দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে একজন মানুষ হিসেবে নিজ দায়িত্ব সম্বন্ধে অবগত এবং তা পালনে ব্রত হওয়া উচিত, এমনকি তা যদি তার ইচ্ছার বিরোধী হয় তবুও তা পালন করা উচিত।
দ্বিতীয়ত: এক ইসলামী শাসনব্যবস্থাই সমাজে ইসলামের প্রকৃত বিধিবিধানকে সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন করবে যাতে করে সেই সমাজের কেউই যেন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উপাসনা না করে এবং সবাই পূর্ণ স্বাধীনতাসহ ব্যক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার ভোগ করতে পারে। আর এ দুই মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে এমন এক ব্যক্তির প্রয়োজন যিনি সরাসরি আল্লাহ পক্ষ হতে নিষ্পাপ গুণের অধিকারী হবেন। অন্যথা, হয়তো এমন কোনো লোক সেই শাসনব্যবস্থা ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের আসনের অধিকারী হয়ে বসবে, যে তার সেই গুরুদায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে চিন্তাগত পথভ্রষ্টতা বা বিশ্বাসঘাতকতার সম্ভাবনা থেকে মুক্ত নয়। এর ফলে তখন ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা ব্যাহত হবে এবং ইসলামী শাসনব্যবস্থা এক অত্যাচারী একনায়ক বা রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রূপান্তরিত হবে। তখন ইসলামের পবিত্র জ্ঞানভান্ডার পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের মতই স্বেচ্ছাচারী ও স্বার্থান্বেষী পন্ডিত মহলের দ্বারা বিকৃতির স্বীকার হবে। বিশ্বনবীর (সা.) সাক্ষ্য অনুযায়ী একমাত্র যে ব্যক্তি কথায় ও কাজে এ পদের উপযুক্ত ছিলেন এবং যাঁর পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্ পবিত্র কুরআন ও রসুলের (সা.) সুন্নাহ অনুযায়ী ছিল তিনি হচ্ছেন হযরত ইমাম আলী (আ.)। (আল্ বিদায়াহ্ ওয়ান্ নিহায়াহ্, ৭ম খন্ড, পৃ. ৩৬০।)
যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠদের বক্তব্য ছিল এই যে, কুরাইশরা খেলাফতের ব্যাপারে হযরত আলীর (আ.) ন্যায্য অধিকারের বিরোধী তবুও তাদের উচিত ছিল বিরোধীদেরকে সত্যের দিকে ফিরে আসতে বাধ্য করা এবং বিদ্রোহীদেরকে দমন করা; ঠিক যেমনটি যাকাত অস্বীকারকারীদের সঙ্গে করা হয়েছিল। এমনকি তাদের সঙ্গে যুদ্ধও করা হয়েছিল তবুও যাকাত আদায় থেকে তাদেরকে বিরত হতে দেয়া হয়নি। তাই কুরাইশদের বিরোধিতার ভয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার কাজ থেকে হাত গুটিয়ে সত্যকে হত্যা করা তাদের কখনও উচিত হয়নি। নির্বাচিত খেলাফতকে সম্মতিদান থেকে যে কারণটি শীয়াদের বিরত রেখেছিল তা ছিল এই ঘটনার অনাকাংখিত পরিণতি যা ইসলামী শাসনব্যবস্থার জন্যে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসত এবং ইসলামের সুমহান শিক্ষার ভিত্তিকে ধ্বংস করে দিত। বাস্তবিকই পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে ক্রমেই এ ধারণার সত্যতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। এর ফলে শীয়াদের এ সংক্রান্ত বিশ্বাস আরও দৃঢ় হতে থাকে। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ে শীয়ারা বাহ্যত হাতে গোনা অল্প কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলেন যা বৃহত্তর জনসমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিলেন তথাপি পবিত্র আহলে বাইত (আ.) গোপনে ইসলামের শিক্ষাদান কর্মসূচী এবং নিজস্ব পদ্ধতিতে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যান। অন্যদিকে, এর পাশাপাশি ইসলামী শক্তির উন্নতি ও সংরক্ষণের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁরা শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধিতা থেকে বিরত থাকেন। এমনকি শীয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব জিহাদেও অংশগ্রহণ করতেন এবং জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনে হস্তক্ষেপও করতেন। স্বয়ং হযরত আলী (আ.) ইসলামের স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠদের পথনির্দেশনা দিতেন। (তারীখে ইয়াকুবী, পৃ. ১১১, ১২৬ ও ১২৯।)
24
