হযরত আবু যার গাফফারী (রা.)এর সংক্ষিপ্ত জীবনি

by Shihab Iqbal

হযরত আবু যর গিফারী (রাঃ) ছিলেন রাসূল (সাঃ) এর একজন প্রিয় সাহাবী তার পূর্ব পরিচিত ছিল এরূপঃ বাইরের জগতের সাথে মক্কার সংযুক্তি ঘটিয়েছে যে, আদ্দান উপত্যকাটি,সেখানেই ছিল গিফার গোত্রের বসতি জুনদুব ইবনে জুনাদাহ আবু যর নামেই যিনি পরিচিততিনিও ছিলেন কবীলার সন্তান

বাল্যকাল থেকেই তিনি অসীম সাহস, প্রখর বুদ্ধিমত্তা দূরদৃষ্টির জন্য ছিলেন সকলের থেকে স্বতন্ত্র। জাহেলী যুগে জীবনের প্রথম ভাগে তার পেশাও ছিল রাহাজানি। গিফার গোত্রের একজন দুঃসাহসী ডাকাত হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তবে কিছুদিনের মধ্যে তার জীবনে ঘটে যায় এক পরিবর্তন। তার গোত্রীয় লোকেরা এক আল্লাহ ছাড়া সকল মূর্তির পূজা করত। তাতে তিনি গভীর ব্যথা অনুভব করতেন। কিছুদিন পরেই তিনি নিজেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হলেন। তার ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি বেশ চমকপ্রদ। ইবনে হাজারআল ইসাবাগ্রন্থে তার ইসলাম গ্রহণের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। সংক্ষেপে এভাবে বলা যায়, তিনি তার গোত্রের সাথে বসবাস করছিলেন। একদিন সংবাদ পেলেন মক্কায় এক নতুন নবীর আবির্ভাব হয়েছে; তাই তিনি তার ভাই আনিসকে ডেকে বললেনঃ তুমি একটু মক্কায় যাবে। সেখানে যিনি নিজেকে নবী বলে দাবি করেন এবং আসমান থেকে তার কাছে ওহী আসে বলে প্রচার করে থাকেন; তার সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করবে, তার মুখের কিছু কথা শুনবে। তারপর ফিরে এসে আমাকে অবহিত করবে। আনিস মক্কায় চলে গেলেন। রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে তার মুখ নিঃসৃত বাণী শ্রবণ করে নিজ গোত্রে ফিরে এলেন। আবু যর (রাঃ) খবর পেয়ে তখনই ছুটে গেলেন আনিসের কাছে। অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে নতুন নবী সম্পর্কে নানান কথা তাকে জিজ্ঞেস করলেন। আনিস বললেনঃ কসম আল্লাহর। আমি তো লোকটি দেখলাম, মানুষকে তিনি মহৎ চরিত্রের দিকে আহ্বান জানাচ্ছেন। আর এমন কথা বলেন যা কাব্য বলেও মনে হল না। মানুষ তার সম্পর্কে কি বলাবলি করে? কেউ বলেতিনি একজন যাদুকর, কেউ বলে গণক, আবার কেউ বলে কবি। আল্লাহর কসম। তুমি আমার তৃষ্ণা মেটাতে পারলে না। আমার আকাঙক্ষাও পূরণ করতে সক্ষম হলে না। তুমি কি পারবে আমার পরিবারের দায়িত্বভার গ্রহণ করতে, যাতে আমি মক্কায় গিয়ে স্বচক্ষেই তার অবস্থা দেখে আসতে পারি? তবে আপনি মক্কাবাসীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন।পরদিন সকালে আবুযর চললেন মক্কার উদ্দেশ্যে। সাথে নিলেন কিছু পাথেয় এক মশক পানি। সর্বদা তিনি শংকিত, ভীত চকিত। কোন ব্যক্তির কাছে মুহাম্মদ (সাঃ) সম্পর্কে কোন কথা জিজ্ঞেস করা তিনি সমীচীন মনে করলেন না। কারণ, তার জানা নেই জিজ্ঞাসিত ব্যক্তিটি মুহাম্মদের বন্ধু না শত্রম্ন? দিনটি কেটে গেল। রাতের আঁধার নেমে এল। তিনি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। বিশ্রামের উদ্দেশ্যে তিনি শুয়ে পড়লেন মাসজিদুল হারামের এক কোণে। আলী ইবন আবী তালিব যাচ্ছিলেন সে পথ দিয়েই। দেখে তিনি বুঝতে পারলেন লোকটি মুসাফির। ডাকলেন, আসুন আমার বাড়িতে। আবুযর গেলেন তার সাথে এবং সেখানেই রাতটি কাটিয়ে দিলেন।সকালবেলা পানির মশক খাবারের পুঁটলিটি হাতে নিয়ে আবার ফিরে এলেন মাসজিদে। তবে দুজনের একজন একে অপরকে কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। পরের দিনটিও কেটে গেল। কিন্তু নবীর সাথে পরিচয় হল না। আজো মাসজিদে শুয়ে পড়লেন। আজো আলী (রাঃ) আবার সে পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন। বললেনঃ ব্যাপার কি, লোকটি আজো তার গন্তব্যস্থল চিনতে পারেনি? তিনি তাকেই আবার সাথে করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। রাতটি সেখানে কেটে গেল। এদিনও কেউ কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। একইভাবে তৃতীয় রাতটি নেমে এল। আলী (রাঃ) আজ বললেনবলুন তো আপনি কি উদ্দেশ্যে মক্কায় এসেছেন? তিনি বললেন, যদি আমার কাছে অঙ্গীকার করেন, আমার কাঙিক্ষত বিষয়ের দিকে আপনি আমাকে পথ দেখাবেন, তাহলে আমি বলতে পারি। আলী (রাঃ) অঙ্গীকার করলেন। আবু যর বললেনঃ আমি অনেক দূর থেকেই মক্কায় এসেছি নতুন নবীর সাথে সাক্ষাৎ করতে এবং তিনি যেসব কথা বলেন, তার কিছু শুনতে। আলীর (রাঃ) মুখমণ্ডল আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, আল্লাহর কসম, তিনি নিশ্চিত সত্য নবী। একথা বলে তিনি নানাভাবে নবীর (সাঃ) পরিচয় দিলেন। তিনি আরো বললেন, সকালে আমি যেখানেই যাই, আপনি আমাকে অনুসরণ করবেন। যদি আমি আপনার জন্য আশংকাজনক কোনকিছু লক্ষ্য করি তাহলে প্রস্রাবের ভান করে দাঁড়িয়ে যাব। আবার যখন চলব, আমাকে অনুসরণ করে চলতে থাকবেন। এভাবে আমি যেখানে প্রবেশ করি আপনিও সেখানে প্রবেশ করবেন। প্রিয়নবী দর্শন লাভ তার ওপর অবতীর্ণ প্রত্যাদেশ শ্রবণ করার প্রবল আগ্রহ উৎকণ্ঠায় আবু যর সারাটা রাত বিছানায় স্থির হতে পারলেন না। পরদিন সকালে মেহমান সাথে করে আলী (রাঃ) চললেন রাসূল (সাঃ)-এর বাড়ির দিকে। আবু যর তার পেছনে পেছনে। পথের আশপাশের কোনকিছুর প্রতি তার ভ্রম্নক্ষেপ নেই। এভাবে তারা পৌঁছলেন রাসূল (সাঃ)-এর কাছে। আবু যর সালাম করলেন। আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসূলুল্লাহ। রাসূল (সাঃ) জবাব দিলেন, ওয়া আলাইকাস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ ওয়া বারাকাতুহ। এভাবে আবু যর সর্বপ্রথম ইসলামী কায়দায় রাসূল (সাঃ)-কে সালাম পেশ করার গৌরব অর্জন করেন। অতঃপর সালাম বিনিময়ের পদ্ধতিই গৃহীত প্রচারিত হয়।রাসূল (সাঃ) আবু যরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআনের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করে শোনালেন। সেখানে বসেই আবু যর কালেমায়ে তাওহীদের পাঠ করে নতুন দ্বীনের মধ্যে প্রবেশের ঘোষণা দিলেন এবং তার সাথে সাথেই তাওহীদের বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য ওঠেপড়ে লেগে গেলেন। আবু যর (রাঃ) বলেনআমি মসজিদে এলাম। কুরাইশরা তখন একত্রে বসে গুজব করছে। আমি তাদের মাঝে হাযির হয়ে যতদূর সম্ভব উচ্চকণ্ঠে সম্বোধন করে বললাম, কুরাইশ গোত্রের লোকেরা আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মাদ (সাঃ) আল্লাহর রাসূল। কথা বলার সাথে সাথেই কুরাইশরা ভীতচকিত হয়ে পড়ল এবং একযোগে সবাই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং আমাকে বেদম প্রহার শুরু করল। রাসূলের চাচাআব্বাস আমাকে চিনতে পেরে তাদের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আমাকে তাদের হাত থেকে রক্ষা করলেন। একটু সুস্থ হয়ে আমি রাসূল (সাঃ)-এর কাছে ফিরে গেলাম। আমার অবস্থা দেখে তিনি বললেন, তোমাকে ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলাম না? বললাম ইয়া রাসূলুল্লাহ! নিজের মধ্যে এক প্রবল ইচ্ছা অনুভব করছিলাম। সে ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছি মাত্র।আল্লামা ইবনে হাজার আসকালীন আলইসাবা গ্রন্থে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের সূত্রে বর্ণনা করেছেনরাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন তাবুকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন, তখন লোকেরা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধে গমনের ব্যাপারে ইতস্ততঃ প্রকাশ করতে লাগল। কোন ব্যক্তিকে দেখা না গেলে সাহাবীরা বলতেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ অমুক আসেনি। জবাবে তিনি বলতেন, যদি তার উদ্দেশ্য মহৎ হয়, তাহলে শিগগিরই আল্লাহ তাকে তোমাদের সাথে মিলিত করবেন। এক সময় আবুযরের নামটি উল্লেখ করে বলা হল, সেও পিঠটান দিয়েছে।প্রকৃত ঘটনা হল, তার উটের ছিল মন্থর গতি। প্রথমে তিনি উটটিকে দ্রুত চালাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হয়ে জিনিসপত্র নামিয়ে নিজের কাঁধে উঠিয়ে হাঁটা শুরু করেন এবং অগ্রবর্তী মানজিলে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে মিলিত হন। এক সাহাবী দূর থেকে তাকে দেখে বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ রাস্তা দিয়ে কে একজন যেন আসছে। তিনি বললেনঃ আবু যরই হবে। লোকেরা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করে চিনতে পারল এবং বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ,আল্লাহর কসম, এতো আবু যরই। তিনি বললেন, আল্লাহ আবু যরের ওপর রহমত করুন। সে একাকী চলে, একাকীই মরবে, কিয়ামতের দিন একাই উঠবে। (তারীখুল ইসলামঃ আল্লামা যাহাবী ৩য় খণ্ড) রাসূল (সাঃ)-এর দ্বিতীয় ভবিষ্যৎ বাণীটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। হযরত আবু যর ছিলেন প্রকৃতিগতভাবেই সরল, সাদাসিধে, দুনিয়াবিরাগী নির্জনতা প্রিয় স্বভাবের। কারণে রাসূল (সাঃ) তাঁর উপাধি দিয়েছিলেন– ‘মসিরুল ইসলাম।রাসূল (সাঃ)-এর ওফাতের পর তিনি দুনিয়ার সাথে একেবারেই সম্পর্কহীন হয়ে পড়েন। প্রিয় নবীর বিচ্ছেদে তাঁর অন্তর অভ্যন্তরে যে দাহ শুরু হয়েছিল তা আর কখনো প্রশমিত হয়নি।হযরত আবু যর (রাঃ) এর ওফাতের কাহিনীটিও অত্যন্ত বেদনাদায়ক। হিজরী ৩১ মতান্তরে ৩২ সনে তিনি রাবজার মরুভূমিতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর সহধর্মিনী তাঁর অন্তিমকালীন অবস্থার বর্ণনা করেছেন এভাবেআবু যরের অবস্থা যখন খুবই খারাপ হয়ে পড়ল, আমি তখন কাঁদতে শুরু করলাম। তিনি বললেন, কাঁদছ কেন? বললামঃ এক নির্জন মরুভূমিতে আপনি পরকালের দিকে যাত্রা করছেন। এখানে আমার আপনার ব্যবহ্নত বস্ত্র ছাড়া অতিরিক্ত এমন বস্ত্র নেই যা দ্বারা আপনার কাফন দেয়া যেতে পারে। তিনি বললেনঃ কান্না থামাও। তোমাকে একটি সুসংবাদ দিচ্ছি। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে একজন মরুভূমিতে মৃত্যুবরণ করবে এবং তার মরণের সময় মুসলিমদের একটি দল সেখানে অকস্মাৎ উপস্থিত হবে। আমি ছাড়া সে লোকগুলোর সকলেই লোকালয়ে ইন্তেকাল করেছে। এখন মাত্র আমিই বেঁচে আছি। তাই নিশ্চিতভাবে বলতে পারি সে ব্যক্তি আমিই। সেই কাফেলাটি হল ইয়ামেনী। তারা কুফা থেকে এসেছিল। আর তাদের সাথে ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) কাফিলার সাথে তিনি ইরাক যাচ্ছিলেন। তিনিই আবু যরের জানাযার ইমামতি করেন এবং সকলে মিলে তাকে রাবজার মরুভূমিতে দাফন করেন।
সূত্রঃ তাকরীব ওয়েব সাইট####

সম্পর্কযুক্ত পোস্ট

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Are you sure want to unlock this post?
Unlock left : 0
Are you sure want to cancel subscription?