হযরত আয়াতুল্লাহ আরাকী’র (রহ.) গৃহে পাগড়ী পরার স্মৃতি
মূল: হুজ্জাতুল ইসলাম মোহসিন গারাবিয়ান,
অনুবাদ: ড. এম. এ. কাইউম।
প্রত্যেক মানুষের জীবনে বহু সন্ধিক্ষণ ও বিশেষ স্মরণীয় দিন বিদ্যমান থাকে। প্রত্যেক তালাবার [দীনি প্রতিষ্ঠানের ছাত্র] অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও পছন্দনীয় স্মরণীয় বিষয় হচ্ছে পাগড়ী পরার ঘটনা। আমিও ছাত্রত্বের শুরু থেকে ৬/৭ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে রুহানী [আলেমদের] পোশাকে সজ্জিত হওয়ার চিন্তায় মগ্ন হলাম। ধর্মীয় ছাত্রদের এই পোশাকে সজ্জিত হওয়ার কোনো ষ্টান্ডার্ড ও নির্দিষ্ট সময় নেই। তবে এই প্রথা চালু রয়েছে যে, একজন ধর্মীয় ছাত্র কিছুটা ইসলামী শিক্ষা এবং ফিকহ্ ও উসুলে ফিকহ্ প্রভৃতি শেখার পর এই রুহানী পোশাকে সজ্জিত হয়ে আনুষ্ঠানিক তালাবা (ধর্মীয় ছাত্র) হবে। বাস্তবতা এই যে, এই রুহানী পোশাকই স্বয়ং ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণের অন্যতম বৃহৎ কারণ। কেননা যে, এই পোশাক স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মানুষের জন্যে এক বিশেষ দায়বদ্ধতা সৃষ্টি করে এবং প্রাকৃতিকভাবেই এক বিশেষ আচার-ব্যবহার ও চালচলন কামনা করে। (অবশ্য এর উপযুক্ত ব্যক্তিদের জন্যে।) অনেকেই বিশ^াস করেন যে, রুহানী পোশাকই স্বয়ং মানুষের জন্যে এক বিশেষ তওফিকের [সাফল্য] উৎস হিসেবে কাজ করে যা থেকে পাগড়ীবিহীন লোকেরা বঞ্চিত। সদ্য পাগড়ী পরা এক ভাই আমার নিকট বর্ণনা করেন: “রুহানী পোশাক পরার পর হতে আমি কিছু সাফল্য অর্জন করেছি ও করছি এবং আমি প্রাণপণে বিশ^াস করি যে, আমার এই সফলতা এই পোশাকের কারণেই অর্জিত হয়েছে!!”
আমার বন্ধু-বান্ধবরা একাধিকবার আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন যে, আমি কেন রুহানী পোশাক পরছি না? আমি – প্রকৃতপক্ষে আমার নিজেকে ও অন্যদেরকে প্রতারিত করার জন্যে – বলতাম: “পোশাক পরিধান করতে যোগ্যতা লাগে এবং আমি এখনও যোগ্য হইনি!” এমনকি এক উদাসীন লোক, যে আমাকে বলত, “রুহানী পোশাক তোমাকে চমৎকার মানাবে, তুমি কেন পাগড়ী পরছ না?” তার উত্তরে আমি একজন আলেম ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তির ভান করে বলতাম: “পোশাক আমাকে মানাবে বটে, কিন্তু আমি তো পোশাকে মানাব না!”
কিন্তু কিছু সময় পর উপলব্ধি করতে পারলাম যে, যদি আমি ‘কামেল’ [পরিপূর্ণ] হওয়ার পর রুহানী পোশাক পরতে চাই তাহলে আদৌ কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব না এবং পোশাকও শরীরে পরিধান করতে পারব না! প্রকৃত অবস্থা এই যে, পোশাক পরাটাই স্বয়ং অনেক পরিপূর্ণতার কারণ এবং পূর্ণতার বিভিন্ন স্তরে পৌঁছার মাধ্যম; না এর বিপরীত। অবশ্য, এটি নিশ্চিত যে, মানুষের পূর্ণতা সর্বদাই এক আপেক্ষিক বিষয়; এই প্রেক্ষাপট হতে বলতে হয় যে, মানুষের জন্যে শ্রেয়তর হবে যে, তিনি রুহানী পোশাক পরিধান করার পূর্বেই কতক পূর্ণতা অর্জন করবেন এবং কতক, পোশাক পরিধান করার পর।
আমি শুনলাম যে, সান্নিধ্যপ্রাপ্ত আরেফ [আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব] হযরত আয়াতুল্লাহিল উযমা বেহ্জাতকে (রহ.) এমর্মে প্রশ্ন করা হয়েছিল: “জনাব! আমরা রুহানী পোশাক পরিধান করতে চাই, কিন্তু তার উপযুক্ত নই, কি করব?” উত্তরে তিনি বলেছিলেন: “তাহলে আমি যে আমার শরীরে এ পোশাক পরে আছি, আমি কি এর উপযুক্ত?!” সত্যিই, এটি এক চমৎকার উত্তর। প্রকৃত অবস্থা এই যে, রুহানী পোশাক এক বাহ্যিক বস্তু হলেও মানুষের অভ্যন্তরকে পরিবর্তন করে দেয়, যদিও অনেকেই – যেমন আমি! – প্রকৃতপক্ষে এই পোশাকের আবশ্যকীয় শর্তাদী হতে মুক্তি ও পলায়নের জন্যে অনেক বিলম্বে এই পোশাক পরিধান করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, এ ধরনের পদক্ষেপ ক্ষতিকারক এবং অন্ততঃপক্ষে লাভ বা স্বার্থকে প্রতিহত করা। মানুষের শরীরে যখন রুহানী পোশাক থাকে না তখন সে কোনো স্যান্ডউইচ বিক্রেতার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে স্যান্ডউইচে কামড় দিতে পারে, অথবা জনসাধারণের সম্মুখে ধুমপান করতে পারে, কিংবা পথঘাটের পাশে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিতে পারে ইত্যাদি। কিন্তু শতাধিক সত্য যে, এসব কাজ রুহানী পোশাকের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল নয়। যদিও দুঃখের বিষয় যে, পাগড়ী পরা অনেক লোকই এই পোশাকের সম্ভ্রম রক্ষা করে না এবং সামাজিকভাবে যা বাস্তবায়ন করা উচিৎ নয় তাই তারা বাস্তবায়ন করে। লোকেরা হয় এই পোশাক পরিধান করবে না, কিংবা এটি শরীরে তুল্লে অবশ্যই এর মান-মর্যাদা রক্ষা করবে! এ কথা ঠিক যে, কতক আচার-ব্যবহার হতে বিরত থাকা কঠিন ও জটিল; কিন্তু প্রবাদ রয়েছে: “কেউ খরবুজা [বাঙ্গী জাতিয় ফল বিশেষ] খেলে পায়ের কাঁপুনিও শুরু হবে!” অহেতুক বলা হয়নি:
“কষ্ট না করলে গুপ্ত ধনভাÐার সহজ হয় না। পারিশ্রমিক-প্রতিদান সেই লাভ করে যে ভাই কাজ করে।”
হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে সামর্থ্য দাও যাতে আমরা শুধু কথাই না বলি এবং শুধু জ্ঞানের ধারকই না হই; বরং আমলের অধিকারীও যেন হতে পারি! হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে রুহানী পোশাক পরিধান করার এবং এই পোশাকের আবশ্যকীয় দায়িত্বসমূহের প্রতি আমল করার সামর্থ্য দান কর!
১৫ই শাবান, ১৪০৬ হিজরী, মোতাবেকে ১৫ই উর্দীবেহেশÍ, ১৩৬৫ ফার্সী সৌর হিজরী রাতে আমরা কয়েকজন সম্মানিত ভাই – যেমন: জনাব শামেলী, জনাব সাঈদী রওশান, জনাব সাজেদী প্রমুখ – একত্রে, পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে, মাগরিব ও ইশা’র নামাযান্তে, ইশ্ক আলী গোলীতে অবস্থিত হযরত আয়াতুল্লাহিল উযমা আরাকীর (রহ.) গৃহে গমন করলাম। কয়েক মিনিট দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে রইলাম, কেউ দরজা খুল্লেন না। অতঃপর তাঁরই সম্মানিত ছেলে জনাব হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন মুসলেহী (আল্লাহ তাঁর সাফল্য অব্যাহত রাখুন!) নামায সমাপ্ত করে ফিরে এসে, সঙ্গে থাকা চাবী দ্বারা দরজা খুল্লেন। গৃহে একমাত্র হযরত আয়াতুল্লাহ ব্যতীত আর কেউ ছিলেন না। বাড়ীটি অত্যন্ত প্রাচীন ছিল এবং সেটি মালিকের পরহেযগারিতা ও দুনিয়া বিমুখতার পরিচয় বহন করছিল! আয়াতুল্লাহিল উযমা আরাকী (রহ.) এমন এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে, তাঁর তাকওয়া ও খোদাভিরুতার বিষয়টি সকলেই জানত এবং তাঁর বদান্যতা, পূর্ণতা, আধ্যাত্মিকতা ও পবিত্রতার স্তরগুলো কারও কাছেই গোপন ছিল না। তিনি একজন বয়স্ক মুজতাহিদ, পাকা দাড়ি বিশিষ্ট এক বয়ঃবৃদ্ধ আরেফ এবং সর্বদা ইল্ম, তাকওয়া ও ফযিলতের ভার বহনকারী ব্যক্তিত্ব। তাঁর ন্যুব্জ হওয়া দেহ, চোখের চশমা, চোখের সাদা ভ্রæর মধ্যখানে তাঁর প্রভাবশালী ও দেবে যাওয়া দৃষ্টি এবং তাঁর সাদা ও জাঁকজমকপূর্ণ দাড়ির পাশে এসব তাঁর সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর চেহারাকে ফুটিয়ে তুলত এবং তাঁকে এক বিশেষ পবিত্রতা দান করত।
গৃহের সদর দরজাটি এক বারান্দার অভিমুখে খুলত এবং কয়েকটি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হত [সদর দরজার সামনে একটু উঁচু বারান্দা ছিল]। বারান্দার বাম দিকে প্রায় ৪ ী ৩ মিটার পরিমাণের একটি কক্ষ ছিল যেখানে তিনি সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। আমরা কক্ষে প্রবেশ করে কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতেই তিনি এই কক্ষ সংলগ্ন অপর এক কক্ষ হতে বেরিয়ে আসলেন। আমরাও কাবা-আবা পরে প্রস্তুত হলাম এবং তারপর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে পাগড়ীগুলো তাঁর হাতে দিচ্ছিলাম। তিনি আমাদের মাথায় পাগড়ী পরানোর পূর্বে একটি দোয়া পাঠ করছিলেন এবং আমাদের মধ্যে যার পালা আসছিল তাকেও পাঠ করতে আদেশ করছিলেন। অতঃপর তিনি এক একটি পাগড়ী হাতে নিয়ে ঘুরাচ্ছিলেন এবং ‘তাহ্তুল হানাক’ [পাগড়ীর এক প্রান্ত যা নামাযের সময় গলার নিচ দিয়ে পিছন পারে ঝুলিয়ে দেয়া হয়] যেন সম্মুখে স্থিত হয় এমনভাবে আমাদের মাথায় স্থাপন করছিলেন। আর মৃদু ও এক বিশেষ হৃদয়গ্রাহী কণ্ঠে বলছিলেন: “তোমার প্রতি আল্লাহ তায়ালার মোবারক হোক!” আমাদের প্রত্যেকেই তাঁর হাতে চুমু দেয়ার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু তিনি আমাদেরকে এ কাজের সুযোগ না দিয়ে হাত গুটিয়ে নিচ্ছিলেন!
আমাদের পাগড়ী পরা সম্পন্ন হলে আমরা তাঁর ছেলেটির নিকট আবেদন জানালাম যে, তিনি যেন স্বীয় পিতার নিকট আমাদেরকে কিছু উপদেশ দেয়ার অনুরোধ জানান। তাঁর শ্রবণশক্তি কিছুটা হ্রাস পেয়ে যাওয়ার ফলে তাঁর ছেলেটি তাঁর নিকটে গিয়ে কানে মুখ লাগিয়ে উচ্চৈঃস্বরে আমাদের বিষয়টি বললেন। আমি তাঁরই (আয়াতুল্লাহ) পাশে বসে থাকাই এবং তাঁর ঐশী ও আধ্যাত্মিক মুখমÐলের মাঝে ডুবে যাওয়াই তাঁর চেহারার প্রকৃত অবস্থা প্রত্যক্ষ করছিলাম।
তিনি বয়ঃবৃদ্ধ হওয়ার পরও এই আবেদন শোনার পর তাঁর মুখমÐলের চামড়ায় ভাঁজ দেখা দিল এবং তাঁর মুখমÐল অবনমিত থাকা অবস্থায় তিনি এক মুচকি হাসি দিয়ে বল্লেন: “আমি যদি তোমাদেরকে নসিহত করি তাহলে আমাকে নসিহত করবে কে?!” অতঃপর তিনি প্রায় ২০ মিনিট যাবৎ তাকওয়া, দুনিয়া বিমুখতা, আত্মসংবরণ ইত্যাদির উপর কথা বল্লেন। তবে প্রকৃতপক্ষে যেটি অত্যন্ত শিক্ষণীয় ও উপদেশমূলক ছিল তা ছিল এই প্রথম বাক্যটি যে, তিনি বলেছিলেন: “… তাহলে আমাকে নসিহত করবে কে?” আমি ভয় পাই! আমি ভয় পাই!! আমি যা কিছু বলব সে ব্যাপারে সর্বপ্রথম আমাকেই পাকড়াও করবে এবং আমার কাঁধের বোঝা হবে। (كَبُرَ مَقْتاَ عِنْدَ اللهِ أَنْ تَقُوْلُوْا مَا لَا تَفْعَلُوْنَ.) বাস্তবিকপক্ষে এর চেয়ে উন্নতমানের কোন্ এমন নসিহত রয়েছে?! একজন বয়ঃবৃদ্ধ মুজতাহিদ, পরিশুদ্ধ, মোত্তাকী, আরেফ, ইবাদতগুযার প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিত্ব, কয়েকজন প্রাথমিক স্তরের দীনি ছাত্রের সম্মুখে এরূপ বিনীতভাবে কথা বলছেন! এখনই নয় যে, এখনই; বরং তিনি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এবং কুরআন, হাদীস, ফিকহ্ ও উসুলে ফিকহ্ ইত্যাদির সেবার মাঝে স্বীয় চুল-দাড়ি সাদা করে দিয়েছেন এবং এখন নগণ্য কয়েকজন তালাবা তাঁর নিকট ওয়াজ-নসিহতের প্রার্থনা করছে! তাঁর জ্ঞান আদৌ তাঁর জন্যে লুক্কায়িত থাকেনি এবং তিনি স্বীয় গুণাবলী ও অলৌকিক ক্ষমতার গর্ব করেননি। বরং তিনি একজন “আলিফ-বা” পড়–য়া মক্তবের ছাত্রের ন্যায় বলছেন যে, তিনি নিজেই ওয়াজ-নসিহতের মুখাপেক্ষী!
হে আল্লাহ! শত-সহ¯্রবার তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাই যে, আমার মত এক অধমকে তোমার এরূপ বিশেষ বান্দা ও মহান ওলীদের সং¯্রব লাভের ও তাঁদেরকে উপলব্ধি করার তওফিক [সামর্থ্য] দান করেছ।
তাঁর বক্তব্য ও উপদেশাবলী সমাপ্ত হতে না হতেই অপর এক তালাবা স্বীয় পিতা ও একজন আত্মীয়কে সঙ্গে নিয়ে তাঁর সমীপে উপস্থিত হয়ে তাঁর বরকতময় হাতে পাগড়ী পরিধান করল। পরিশেষে আমরা সকলেই তাঁর সঙ্গে খোদা হাফেযী করে এবং তদীয় সন্তান হুজ্জাতুল ইসলাম জনাব মুসলেহীকে কষ্ট করার জন্যে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে তাঁদের বাড়ী ত্যাগ করলাম।
হযরত আয়াতুল্লাহ আরাকী’র (রহ.) গৃহে পাগড়ী পরার স্মৃতি
144
আগের পোস্ট