ইমাম আলীর (আ) বিশেষ দশ ফযীলত (শ্রেষ্ঠ ও অনবদ্য গুণ ও বৈশিষ্ট্য)

by Syed Yesin Mehedi

সাইয়েদ আল আওহাদ আবু হামযাহ ইবনে মুহাম্মাদ আয যাইদী আমাদেরকে বর্ণনা (তাহদীস) করেছেনঃ আমাদেরকে আবুল হাসান আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে মেহরাভেইহ আল- ক্বাযভীনী আল- ক্বাত্ত¡ান বর্ণনা করেছেনঃ আমি আবু হাতেম আর রাযীকে বলতে শুনেছিঃ আহমাদ ইবনে হাম্বলের বর্ণনা থেকে (হযরত আলীর) এতসব ফযীলতের সন্ধান পাওয়াটা তাদেরকে (রাবী ও হাদীস শাস্ত্রবিদগণ) অত্যন্ত আশ্চার্য্যাম্বিত ও বিস্মিত করত।
আমর ইবনে মাইমূন বলেছেনঃ আমি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের কাছে উপবিষ্ট ছিলাম। ঠিক তখন ৯ জন পুরুষ ব্যক্তির একটি দল তাঁর কাছে এসে বললঃ হে ইবনে আব্বাস! হয় আপনি আমাদের সাথে উঠুন অথবা এদের মধ্য থেকে (আলাদা হয়ে) আমাদের সাথে একান্ত নিভৃতে বৈঠক (খালওয়াত) করুন। আমর বলেনঃ অতঃপর ইবনে আব্বাস বললেনঃ বরং আমি তোমাদের সাথেই উঠছি। তিনি (আমর) বলেনঃ তিনি (ইবনে আব্বাস) তখন সুস্থ দৃষ্টি শক্তির অধিকারী ছিলেন অর্থাৎ (এ ঘটনা) তাঁর অন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে। আমর ইবনে মাইমূন বলেনঃ তারা কথা বলা শুরু করল, আমরা জানি না যে তারা কী বলেছিলে? আমর বলেনঃ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস কাপড় ঝাড়া দিয়ে এ কথা বলতে বলতে ফিরে আসলেনঃ হায় আক্ষেপ! এরা এমন এক ব্যক্তিকে গালি দিচ্ছে যাঁর ৯-১০টা এমন ফযীলত (গুণ, বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব) আছে যেগুলো অন্য কারো নেই। এরা এমন এক ব্যক্তিকে গালি দিয়েছে যাঁর সম্পর্কে মহানবী (সা) বলেছেনঃ “আমি এমন এক ব্যক্তিকে (খায়বারের রণাঙ্গনে) পাঠাচ্ছি যাঁকে মহান আল্লাহ কখনোই হেয় ও অপদস্থ করবেন না, তিনি মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসেন এবং মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলও তাঁকে ভালোবাসেন। “সম্মান লাভের আকাঙ্খী ব্যক্তিরা এ দুর্লভ সম্মান পাওয়ার আকাঙ্খী হলে তিনি (সা) বললেনঃ “আলী কোথায়? “তখন বলা হলঃ “তিনি যাঁতাকলে গম পিসে আটা করছেন। “তিনি (সা) বললেনঃ “যাঁতাকলে গম পিসে আটা করার জন্য কেউ নেই কি? “ইবনে আব্বাস বলেনঃ “অতঃপর তিনি (আলী) আগমন করলেন সেখানে এমন অবস্থায় যে তিনি চোখ ওঠা রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। “ইবনে আব্বাস বললেনঃ “অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর দুচোখে মুখের লালা লাগিয়ে দিলেন এবং এরপর তিনবার পতাকা ঝাকিয়ে তাঁর হাতে সোপর্দ করলেন। আর আলী (আ) (খাইবর দুর্গ জয় করে) সাফীয়া বিনতে হুওয়াইকে নিয়ে (মহানবীর সা কাছে) প্রত্যাবর্তন করলেন।” ইবনে আব্বাস বললেনঃ অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) অমুক ব্যক্তিকে সূরা-ই তওবা সহ পাঠালেন। কিন্তু তিনি (সা) আলীকে তাঁর পিছনে পাঠিয়ে দিলেন, অতঃপর তিনি (আলী) সূরা – ই তওবা তার কাছ থেকে নিয়ে নিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা) তখন বললেনঃ “একমাত্র ঐ ব্যক্তি পারবে এই সূরা নিয়ে যেতে (ও তা প্রচার করতে) যে আমার থেকে এবং আমিও তার থেকে। “
ইবনে আব্বাস বললেনঃ মহানবী (সা) তাঁর পিতৃব্য পুত্রদেরকে বললেনঃ “তোমাদের মধ্য থেকে কে আমাকে দুনিয়া ও আখেরাতে আমার সাথী ও সহযোগী হবে? “আর আলীও তখন তাদের সাথে সেখানে উপবিষ্ট ছিলেন। এ কথা বলার পর রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের প্রত্যেকের কাছে এসে বলতে লাগলেনঃ “তোমাদের মধ্য থেকে কে আমার সহযোগী ও সাহায্যকারী হবে? “কিন্তু তারা সবাই প্রত্যাখান করলে তিনি (সা) আলীকে বললেনঃ “তুমি দুনিয়া ও আখেরাতে আমার ওয়ালী (সহযোগী, সহকারী ও সাহায্যকারী)।”
ইবনে আব্বাস বললেনঃ খাদীজার পরে আলী ছিলেন জনগণের মধ্যে যারা ঈমান এনেছিল তাদের (মধ্যে) প্রথম ব্যক্তি।
ইবনে আব্বাস বললেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) স্বীয় বস্ত্র (চাদর) আলী, ফাতিমা, হাসান ও হুসাইনের ওপর টেনে ও ঢেকে দিয়ে বলেছিলেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ চান হে আহলুল বাইত! তোমাদের থেকে পাপপঙ্কিলতা (রিজস) দূর করতে এবং তোমাদেরকে পবিত্র করার মতো (পূর্ণ রূপে) পবিত্র করতে।”
ইবনে আব্বাস বললেনঃ আর আলী স্বীয় জীবনকে বেঁচে দিয়ে (অর্থাৎ বিপন্ন করে) মহানবীর (সা) বিছানায় শুয়েছিলেন (হিজরতের রাতে [লাইলাতুল মাবীত])। ইবনে আব্বাস বললেনঃ আর মুশরিকরা সেই রাতে রাসূলুল্লাহকে (সা) ঢিল ছুড়ে মারছিল। আলী রাসূলুল্লাহর (সা) বিছানায় যখন শুয়ে ছিলেন তখন হযরত আবু বকর সেখানে আসলেন। তিনি (ইবনে আব্বাস) বললেনঃ আর আবু বকর ভেবেছিলেন যে তিনি (আলী) রাসূলুল্লাহ। ইবনে আব্বাস বললেনঃ আবু বকর বললেনঃ “হে নবীয়াল্লাহ! “তখন তাঁকে আলী বললেনঃ “মাইমূনার ক‚ঁয়োর দিকে রাসূলুল্লাহ (সা) বের হয়ে গেছেন। অতঃপর আপনি সেখানে গিয়ে তাঁর সাথে মিলিত হন। “তিনি (ইবনে আব্বাস) বললেনঃ অতঃপর আবুবকর চলে গেলেন এবং তাঁর (সা) সাথে গুহায় প্রবেশ করলেন। ইবনে আব্বাস বললেনঃ অতঃপর যেমন ভাবে মহানবীকে (সা) পাথর মারা হত ঠিক তেমন ভাবে আলীকেও পাথর মারা হচ্ছিল (সেই রাতে)। তিনি (আলী) পার্শ্বদেশ পরিবর্তন করছিলেন। তবে তিনি চাদর দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছিলেন এবং ভোর হওয়া পর্যন্ত চাদর থেকে মাথা বের করেন নি। অতঃপর ভোর হলে তিনি চাদর সরালেন এবং তখন মুশরিকরা বললঃ আমরা ঢিল নিক্ষেপ করা সত্তে¡ও তোমার সংগী (রাসূলুল্লাহ তোমার মত) পার্শ্বদেশ পরিবর্তন (এপাশ ওপাশ) করত না অথচ তুমি পার্শ্বদেশ পরিবর্তন করছিলে যা আমরা অপছন্দ করেছি।
অতঃপর ইবনে আব্বাস বললেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) তাবুকের গাযওয়ায় (যুদ্ধ) বের হলেন এবং লোকজনও তাঁর সাথে বের হল। তিনি (ইবনে আব্বাস) বলেনঃ অতঃপর আলী তাঁকে (সাঃ) বললেনঃ “আমি কি আপনার সাথে বের হব? “তিনি (ইবনে আব্বাস) বলেনঃ অতঃপর নবী (সাঃ) তাঁকে বললেনঃ “না। “অতঃপর আলী কাঁদলেন এবং তিনি (মহানবী) তাঁকে বললেনঃ তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে মূসার কাছে হারূনের মর্যাদা ও অবস্থান ঠিক যেমন ঠিক তেমন আমার কাছে তোমার মর্যাদা ও অবস্থান হোক তবে আমার পরে কোনো নবী নেই?! তুমি যে আমার খলীফা (প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত) তা (বাস্তবায়িত হওয়া) ব্যতীত আমার প্রস্থান করা অনুচিত (অর্থাৎ তোমাকে আমার খলীফা ও স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করা ব্যতীত আমার কোথাও যাওয়া ও প্রস্থান করা অনুচিৎ)। “
ইবনে আব্বাস বললেনঃ আর তাঁকে (আলী) রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেনঃ “তুমি আমার পরে প্রত্যেক মুমিন নর নারীর ওয়ালী (অর্থাৎ কর্তৃত্বশীল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক ও তত্ত¡ধায়ক)। “
ইবনে আব্বাস বললেনঃ আর রাসূলুল্লাহ (সা) কেবল আলীর ঘরের দরজা ব্যতীত মসজিদের সকল দরজা বন্ধ করে দেন (অর্থাৎ মসজিদের দিকে উন্মুক্ত অন্য সকল ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন)। হযরত আলী জুনুব (যৌন কারণে নাপাক) অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করতেন এবং এটা ব্যতীত তাঁর জন্য ঘরে প্রবেশের আর কোনো পথ ছিল না।
ইবনে আব্বাস বললেনঃ আর রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছিলেনঃ আমি যার মওলা (নেতা, কর্তৃপক্ষ, পরিচালক ও প্রশাসক) তার মওলা হচ্ছেন আলী।
ইবনে আব্বাস বললেনঃ মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে আমাদেরকে জানিয়েছেন যে তিনি বৃক্ষের নীচে বাইআতকারীদের (আসহাব-ই শাজারাহ্) ব্যাপারে সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তিনি তাদের অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে জ্ঞাত ও অবগত আছেন। মহান আল্লাহ কি আমাদের জানিয়েছেন যে তিনি এরপর তাদের ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছেন?
ইবনে আব্বাস বললেনঃ “আর যখন উমর বললেনঃ আমাকে অনুমতি দেন, আমি তার গর্দান উড়িয়ে দেই। “তখন মহানবী (সা) তাকে বললেনঃ “আর তুমি এটা করতে যাচ্ছিলে তোমার কি জানা আছেঃ অবশ্যই মহান আল্লাহ আহলে বদরের (অর্থাৎ বদরের যোদ্ধাদের) অন্তর্যামী এবং তাদের ব্যাপারে জানেন দেখেই তিনি বলেছেনঃ “তোমরা যা চাও (ও ইচ্ছা কর) তা করে যাও বা করতে পার (اعملوا ما شئتم) “[ তবে নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ সব কিছুর সম্যক দ্রষ্টা এবং তিনি রোয হাশরে সবকিছুর হিসাব নিবেন। ]
হাকিম নিশাপুরী বলেনঃ এটা সহীহুল ইসনাদ হাদীস এবং এই সিয়াকাহ (বাক্যের ধারা ও বাচনরীতি) সহ তারা (বুখারী ও মুসলিম) তা রিওয়ায়ত করেন নি।
সাইয়েদ আল আওহাদ আবু হামযাহ ইবনে মুহাম্মাদ আয যাইদী আমাদেরকে বর্ণনা (তাহদীস) করেছেনঃ আমাদেরকে আবুল হাসান আলী ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে মেহরাভেইহ আল -ক্বাযভীনী আল- ক্বাত্ত¡ান বর্ণনা করেছেনঃ আমি আবু হাতেম আর- রাযীকে বলতে শুনেছিঃ আহমাদ ইবনে হাম্বলের বর্ণনা থেকে (হযরত আলীর) এতসব ফযীলতের সন্ধান পাওয়াটা তাদেরকে (রাবী ও হাদীস শাস্ত্রবিদগণ) অত্যন্ত আশ্চর্য্যাম্বিত ও বিস্মিত করত।
সূত্রঃ আল-হাকিম আননিশাপূরী, আল-মুস্তাদ্রাক আলাস্ সহীহাইন, খঃ ৩, পৃঃ ৩৪৪-৩৪৫ ; হাদীস নং ৪৭১০, দারুল ফিকর, বৈরুত লেবানন , মুদ্রণ কাল : ২০০২ খ্রী: ; আর আল্লামা যাহাবী আত-তালখীস গ্রন্থে তাঁর সাথে (হাকিম নিশাপুরী) সাথে একমত পোষণ করে বলেছেনঃ (হাদীসটি) সহীহ।
অনুবাদ: ইসলামী চিন্তাবিদ এবং গবেষক হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলেমিন মুহাম্মদ মুনীর হুসাইন খান।

সম্পর্কযুক্ত পোস্ট

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Are you sure want to unlock this post?
Unlock left : 0
Are you sure want to cancel subscription?