বল, তিনি আল্লাহ্ – এক।
তাওহীদ, আসমানী সমস্ত দ্বীনের মৌলিক ভিত্তিসরূপ। নবীগণ আগমন করেছেন যাতে শির্ক, কুফর ও মূর্তিপূজার চিহ্নকে ধ্বংস এবং জনগণকে এক আল্লাহর দিকে আহবান করতে পারেন।
তাওহীদ, নবীগণের সার্বিক শিক্ষাদানের আত্মা ও প্রাণ। এটি না শুধু আক্বীদা-বিশ্বাসে, বরং ধর্মীয় বিধিবিধান এবং নৈতিক চরিত্র ও একত্ববাদের মূলে সুপ্রতিষ্ঠিত।
‘একত্ববাদ’ ঈমান ও কুফরের মধ্যবর্তী বর্ডার এবং একত্ববাদ গ্রহণ ব্যতীত ঈমানের দূর্গে প্রবেশ করা সম্ভব নয়: “কুলূ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু তুফলিহুন।”(বিহার, ১ম খন্ড, পৃ. ২০২ )
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু হিসনী ফামান্ দাখালা হিসনী আমিনা মিন্ আযাবী।” (প্রাগুক্ত, ৩য় খন্ড, পৃ. ১৩)
এ সূরা একত্ববাদের নির্ভেজাল আকীদা-বিশ্বাসের সমাহার, তাই এর “সূরা এখলাস” হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। অত্র সূরাটি খৃস্টানদের ত্রিত্ববাদ সংক্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস, ইয়াহুদীদের দ্বৈতবাদ এবং অজ্ঞ আরবদের ধ্যান-ধারণা যারা ফেরেশতাগণকে আল্লাহ্র কন্যা জ্ঞান করত সেসবকে প্রত্যাখ্যান করে।
তাওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর নিমিত্তে সর্বপ্রকার অংশীদার ও সমকক্ষতা হতে চিন্তাভাবনা ও কাজকর্মকে মুক্ত করা। না বাহ্যিক শির্ক আর না লোক দেখানো কর্মগত শির্ক। বরং লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে একক খোদা এবং কাজের আত্মাও হতে হবে খোদায়ী ও ঐশী।
“কুল্ হুওয়াল্লাহু আহাদ্”, অর্থাৎ তিনি একক, তাঁর কোনো দ্বৈত নেই, অনুরূপ ও সাদৃশ্য নেই, অংশ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই।
“কুল্ হুওয়াল্লাহু আহাদ্”, অর্থাৎ তিনি এমন এক উপাস্য যিনি প্রত্যেক ক্ষেত্রেই অদ্বিতীয়। আর সে জন্যেই মানুষ তাঁর সত্তাকে বুঝতে ও অনুধাবন করতে অপারগ।
তাঁর একক হওয়ার প্রমাণ এই যে, যদি দ্বিতীয় কোনো আল্লাহ থাকত তাহলে তিনিও নবী প্রেরণ করতেন যাতে মানুষ তাঁকে চিন্তে পারে ও তাঁর আনুগত্য করে!
তাঁর একক হওয়ার অপর প্রমাণ এই যে, সমস্ত মানুষই বিপদের সময় শুধু একটিমাত্র বিন্দুর প্রতি মনোযোগদান করে এবং তাদের অন্তরও সাক্ষ্য দেয় যে, শুধু একটিই কেন্দ্রবিন্দু আছেন যিনি মুশকিল ও মুসিবতের সময় মানুষের প্রাণে আশার সঞ্চার করেন।
তাঁর একক হওয়ার আরও প্রমাণ হচ্ছে আসমান ও যমিনের মাঝে পারস্পরিক সমন¦য়, মানুষ ও অস্তিত্ব এবং সমস্ত সৃষ্টির মাঝে সুশৃংখল ও সূক্ষাতিসূক্ষ সম্পর্ক বিদ্যমান। যদি আপনারা কয়েকজন চিত্রশিল্পীকে একটি ছবি অংকনের নির্দেশ দেন, যেমন একজনকে বলেন: সে মোরগের মাথা আঁকবে, দ্বিতীয়জন তার শরীর রূপায়ণ করবে এবং তৃতীয় চিত্রকর মোরগের লেজ ও পা আঁকবে; এরপর অংকিত তিনটি খন্ডচিত্রকে যখন পাশাপাশি রাখবেন তখন দেখবেন যে, মাথা, শরীর ও পায়ের মাঝে পারস্পরিক সমন¦য় নেই, একটি বড় আর একটি ছোট। একটি সুশ্রী ও একটি বিশ্রী।
হ্যাঁ, সূর্য, চন্দ্র ও পৃথিবীর মাঝে, জলবায়ূ ও মাটির মাঝে, পাহাড়, সমভূমি ও দরিয়ার মাঝে সমন্বয় এবং মানুষের প্রয়োজনাদিসহ এসবই স্রষ্টার এককত্বের প্রমাণ বহনকারী। মানুষ অক্সিজেন গ্রহণ করে ও কার্বনডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে।
আর উদ্ভিদ কার্বনডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে ও অক্সিজেন তৈরী করে যাতে মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টিজীবের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে। আর এ পারস্পরিক সমন¡য়, মানুষ ও উদ্ভিদের জীবনধারণের মৌলিক রহস্য।
শিশুদের প্রয়োজনগুলোকে পিতা-মাতার ভালবাসার মাধ্যমে পূরণ করান এবং দিনের ক্লান্তিকে রাতের ঘুমের মাধ্যমে দূরীভূত করান। চোখের পানিকে লবণাক্ত এবং মুখের পানিকে মিষ্টি করে সৃষ্টি করেছেন যাতে একটি চোখ যেটিকে অনুভূতিপ্রবণ কোষ হিসেবে তৈরী করা হয়েছে সেটিকে লবণাক্ত পানি দ্বারা ধৌত করতে পারে এবং অপরটি খাদ্যকে চিবানো ও হজমের উপযোগী করতে পারে।
নবজাত শিশুকে ফুৎকার দেওয়ার পরিবর্তে চোষার অভ্যাস শিক্ষা দিয়েছেন এবং ভূমিষ্ট হওয়ার পূর্বেই মায়ের স্তনে দুধের সঞ্চার করেছেন। সমুদ্রে তিমির দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাদ্যদ্রব্যকে আকাশে উড্ডয়নরত পাখির আহার হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। আর প্রয়োজন অনুপাতে প্রত্যেক প্রাণীর জন্যে খাদ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন।
জঙ্গে জামালে (উষ্ট্রের যুদ্ধ) একজন আরব যাযাবর হযরত আলীকে (আ.) তাওহীদের অর্থ জিজ্ঞেস করলে যোদ্ধারা অভিযোগ করেন যে, এখন এ ধরনের প্রশ্নাবলির সময় নয়। কিন্তু হযরত আলী (আ.) ঘোরতর যুদ্ধের মাঝে সে ব্যক্তির নিকট তাওহীদের অর্থ ও ব্যাখ্যা প্রদান করেন এবং তৎক্ষণাত তিনি বলেন: আমরা এই অর্থের জন্যেই বিরোধীদের সঙ্গে যুদ্ধ করছি।
হ্যাঁ, ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় আমরা দেখতে পাই সত্যের অনুসারীরা তাওহীদের পতাকাকে সমুন্নত রাখার জন্যেই যুদ্ধ করেছিলেন।( তাফসীরে নুরুস্ সাকালাইন, ৫ম খন্ড, পৃ. ৭০৯)
( সূত্র : তাফসীরে নামায গ্রন্থ থেকে)