পিতামাতাকে সম্মান করার গুরুত্ব অনেক ধর্মের বিশেষ করে ইব্রাহিমীয় বিশ্বাসের একটি প্রধান বিষয়। এটি বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের ক্ষেত্রে সত্য। মহানবী (সা.) এবং পবিত্র কুরআন সর্বশক্তিমানের একটি একক নির্দেশ পুনরাবৃত্তি করে, “তোমাদের পিতামাতার প্রতি সদয় হও। ” যদিও বেশিরভাগ মুসলমানের মনে এই বার্তাটি গেঁথে আছে (প্রায়শই ইসলাম তাদের পিতামাতাকে সম্মান করার নির্দেশ দেয়), এই সাধারণ নির্দেশ থেকে আমরা কিছু বুঝতে পারি। তদুপরি, ইসলাম অনুসারে আমরা মায়ের মর্যাদার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শ্রদ্ধা দেখতে পাই।
পবিত্র কুরআনে পিতামাতার প্রতি সদয় আচরণ: শুরুতেই বিশ্বাসী এবং তাদের পিতামাতার ক্ষেত্রে আল্লাহর আদেশের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা সহায়ক। আমরা পবিত্র কুরআনে এটি দেখতে পাই ঃ তোমাদের প্রভু আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না এবং তোমাদের পিতামাতার প্রতি সদয় আচরণ করো। যদি তোমাদের পিতামাতার কেউ অথবা উভয়েই বৃদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে তাদের সাথে এমন কথা বলো না যা তোমার সামান্যতম হতাশা প্রকাশ করে। তাদের সাথে কখনও তর্ক করো না, বরং সর্বদা তাদের সাথে সদয়ভাবে কথা বলো। তাদের প্রতি বিনয়ী ও করুণাময় হও এবং বলো, “হে প্রভু, তাদের প্রতি দয়া করো যেমন তারা আমার শৈশবে আমাকে লালন-পালন করেছে। ” (সুরা আল-ইসরা: ২৪)
পবিত্র কুরআন অনুসারে, একমাত্র পাপ যা আল্লাহ ক্ষমা করেন না তা হলো, কোন কিছুকে তাঁর সমকক্ষ মনে করা, “নিশ্চয় আল্লাহ তার সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করেন। আর যে-ই আল্লাহর সাথে শরীক করে, সে এক মহাপাপ রটনা করে।” (সুরা আন-নিসা: ৪৮)
প্রকৃতপক্ষে, ইসলামী বিশ্বাসের প্রধান নীতি হল আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার করা। অতএব, উপরের আয়াতগুলি থেকে আমরা সহজেই দেখতে পাই যে, আল্লাহ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং গুরুতর আদেশ জারি করেছেন যখন তিনি বলেন, “তোমাদের পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারও উপাসনা করো না।” এটা যুক্তিসঙ্গত যে, যদি কুরআন এই একক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশের পরে অবিলম্বে অন্য কোনও নির্দেশ দেয়, একই বাক্যে তা বাদ দিলেও, এটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এইক্ষেত্রে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকে কেবল তাঁরই উপাসনা করার আদেশ দেন এবং অবিলম্বে “তোমাদের পিতামাতার প্রতি সদয় হও” এই অতিরিক্ত আদেশটি যোগ করেন।
পবিত্র কুরআনে মায়ের উপর গুরুত্বারোপ: এখন যেহেতু আমরা আল্লাহর দৃষ্টিতে পিতামাতার মর্যাদা দেখতে শুরু করেছি, তাই এটা লক্ষণীয় যে, তিনি মায়ের প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন। পবিত্র কুরআনে আমরা এটিকে দয়ার মূল বিষয়বস্তুর একটি সুন্দর ধারাবাহিকতায় দেখতে পাই ঃ
আমি মানুষকে তার পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার উপদেশ দিয়েছি; তার মা তাকে কষ্টের সাথে গর্ভে ধারণ করেছে এবং প্রচুর যন্ত্রণা সহ্য করে তাকে প্রসব করেছে। (সুরা আল-আহকাফ ঃ ১৫)
অন্য একটি সুরায় বলা হয়েছে ঃ
আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে এবং তার স্তন্যপান ছাড়াতে দু’বছর অতিবাহিত হয়। সুতরাং তুমি আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। আমারই নিকট (সকলের) প্রত্যাবর্তন। (সুরা লুকমান ১৪)
উভয় ক্ষেত্রেই আল্লাহ পিতামাতার কথা বলেন, কিন্তু তারপর তিনি বিশেষভাবে সন্তান ধারণ ও লালন-পালনের ক্ষেত্রে মায়ের কষ্টের কথা উল্লেখ করেন। এটি একটি অসাধারণ ব্যাখ্যা। এভাবে বলতে গেলে, বিশ্বাসীদের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ এবং তার বাইরেও সবকিছুর ¯্রষ্টার বাণী পড়ছি। তাঁর শক্তি অপরিসীম, এবং তাঁর আধিপত্য বিশাল। তবুও এখানে আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিদের সাথে মায়ের দুর্দশার কথা বারবার এবং বিস্তারিতভাবে বলার এবং তা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অন্য কোনও ব্যক্তি বা সৃষ্টি এই ধরনের স্বীকৃতি পায় না। এটি আল্লাহর দৃষ্টিতে মায়ের মর্যাদা এবং গুরুত্ব সম্পর্র্কে অনেক কিছু বলে।
উপরোন্তু একই আয়াত অনুসারে, আল্লাহ তাঁর সৃষ্টিকে তাঁর প্রতি এবং তারপর তাদের মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার নির্দেশ দেন। বিশ্বাসীদের জন্য এটি প্রতিষ্ঠিত করে যে, মায়েদের তাদের সন্তানদের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতা গ্রহণের অধিকার ঐশ্বরিকভাবে নির্ধারিত।
তোমাদের বাবা-মায়ের প্রতি দয়া দেখাও: পবিত্র কুরআন অনুসারে যেমন উপরে দেখা গেছে, পিতামাতার প্রতি সদয় হওয়ার উপর জোর দেওয়া স্পষ্ট। কিন্তু আমাদের কীভাবে এই সদয়তা প্রদর্শন করা উচিত?
এক ব্যক্তি একবার ইমাম জাফর আল-সাদিক (আ.)-কে বললেন, “আমার বাবা অনেক বৃদ্ধ এবং দুর্বল হয়ে পড়েছেন। আমরা তাকে তুলে নিই এবং টয়লেট (ব্যবহার) করতে সাহায্য করি। ” ইমাম বললেন, “যদি তুমি পারো, তাহলে তার জন্য এই সব করো এবং নিজের হাতে তাকে খাওয়াও; আগামীকাল তোমার জন্য জান্নাত। ” (শায়খ আল কুলায়নী, আল-কাফি, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৬২, অধ্যায় ৭০, হাদিস নং ১৫)
এই একটি বর্ণনায় আমরা দেখতে পাই যে, আল্লাহ আমাদের পিতামাতার ক্ষেত্রে কতটা ব্যক্তিগত এবং বিস্তৃত প্রত্যাশা রেখেছেন, যা অভ্রান্ত ব্যক্তিরা আমাদের কাছে প্রকাশ করেছেন। একই সাথে, যষ্ঠ ইমাম (আ.) পিতামাতাদের কষ্ট বা হতাশার কারণ হওয়ার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে, এই বিবেচনা এতটাই বিস্তৃত যে তিনি এমনকি সামান্যতম অসদাচরণও নিষিদ্ধ করেছেন:
বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, ইমাম জাফর আল-সাদিক (আ.) বলেছেন, “পিতামাতার উপর কষ্ট ও হতাশার সর্বনি¤œ রূপ হল (মৌখিক) অভিব্যক্তি, উফ। যদি আল্লাহ উফের চেয়ে কম হতাশাজনক কিছু জানতেন, তাহলে তিনি তা নিষিদ্ধ করতেন। ” (শায়খ আল-কুলায়নী, আল-কাফি, খন্ড২, পৃষ্ঠা ৩৪৮, অধ্যায় ১৪৪, হাদিস নং-১)
বিশ্বাসীদের জন্য এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। যদি আল্লাহ কারো পিতামাতার প্রতি “উফ” বলাও সহ্য না করেন, যা হতাশা বা অসম্মতির মৌখিক প্রকাশ, তাহলে তিনি এর বাইরের কাজ বা কর্ম সম্পর্কে কী বলবেন?
মৃত বাবা-মায়ের প্রতি সদয় হোন: অনেক মানুষ অত্যন্ত ভাগ্যবান যাদের বাবা-মায়ের একজন বা দুজনেই জীবিত এবং সুস্থ আছেন। তবে, আমাদের মধ্যে অনেকের বাবা-মা হয়তো এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। এই ক্ষেত্রে, আমাদের বাবা-মায়ের প্রতি দয়া দেখানোর সুযোগ কি হারিয়ে গেছে? উত্তর হলো না। একটি বর্ণনায় আমরা জানতে পারি যে, ইমাম মুহাম্মদ আল-বাকের (আ.) নি¤œলিখিত কথা বলেছেন:
একজন বান্দা জীবদ্দশায় তার পিতামাতার প্রতি সদয় হতে পারে কিন্তু যখন তারা মারা যায় তখন সে তাদের ঋণ পরিশোধ করে না এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে না। যে ব্যক্তি তার পিতামাতার প্রতি সদয় ছিল আল্লাহ তার কর্মকান্ড লিপিবদ্ধ করেন। কেউ হয়তো তাদের জীবদ্দশায় পিতামাতার প্রতি সদয় ছিল, কিন্তু তাদের মৃত্যুর পরে যখন সে তাদের ঋণ পরিশোধ করে এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে তখন মহান করুণাময় আল্লাহ তার কর্মকান্ড লিপিবদ্ধ করেন যারা তাদের পিতামাতার প্রতি সদয় হয়। (শায়খ আল-কুলায়নি, আল-কাফী, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৬৩, অধ্যায় ৭০, হাদিস নং-২১)
পিতামাতার প্রতি দয়া
55
আগের পোস্ট