সূরা সাফ্ফের তাফসীর

by Syed Yesin Mehedi

গনিমতের মালের লোভে ওহুদের ময়দান ত্যাগ
রেওয়ায়েতে বর্ণিত হয়েছে যে, আলোচ্য আয়াতে (সূরা সাফ্ফের ৪নং আয়াত) বদরের যুদ্ধের প্রতি ইশারা এবং সূরা সাফ্ফ ওহুদের যুদ্ধের পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। অর্থাৎ ওহুদের যুদ্ধের প্রাক্কালে একদল মুসলমানদের মধ্যে যখন দূর্বলতা পরিলক্ষিত হয় এবং সে দূর্বলতার কারণে মুসলিম বাহিনীর পরাজয় ঘটে; তখন এ সূরা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিল হয়। ঘটনাটি খুবই প্রসিদ্ধ এবং আপনাদের অনেকেরই জানা, তা হচ্ছে- রাসূলুল্লাহ (সা.) ৫০ জন মুসলিম যোদ্ধাকে দু’টি পাহাড়ের মধ্যবর্তী একটি কৌশলগত উপত্যকাতে অবস্থান গ্রহণের আদেশ দেন, যাতে শত্রুরা পিছন থেকে হামলা করতে না পারে। ফলে তারা সেখানে অবস্থান নেন এবং রাসূল (সা.) মুসলিম বাহিনী নিয়ে মুশরিকদের বিরুদ্ধে তীব্র হামলা করে তাদেরকে পিছু হটতে বাধ্য করেন। খালিদ বিন ওয়ালীদ -সে তখনও ইসলাম গ্রহণ করে নি এবং সে মুশরিক বাহিনীর অন্যতম সেনাপতি ও আরবের খ্যাতনামা বীর হিসেবে পরিচিত ছিল- কিছু মুশরিক সৈন্যদেরকে নিয়ে অপেক্ষমান ছিল যে, উক্ত দু’টি পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থান (যা একটি সুরঙ্গ ও প্রণালীর ন্যায় ছিল) থেকে হামলা করে মুসলিম বাহিনীকে পরাস্ত করবে। কিন্তু সে যখন দেখল যে, ৫০ জন মুসলিম যোদ্ধা সেখানে পাহারারত অবস্থাতে রয়েছে, তখন সে পিছন থেকে হামলা করার সাহস পায় নি। (আপনারা যদি কেউ যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করেন কিংবা যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে ধারণা থাকে, তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারছেন যে, সুরঙ্গ ও প্রণালী হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে অত্যন্ত কৌশলগত ও স্পর্শকাতর স্থান। এ সব স্থান ব্যবহার করে শত্রুপক্ষকে কোনঠাসা করে রাখা যায়)। এ কারণে রাসূল (সা.) উক্ত স্থানে কিছু মুসলিম যোদ্ধাকে পাহারারত অবস্থায় থাকার আদেশ দিয়েছিলেন, ফলে খালিদ বিন ওয়ালীদের বাহিনী সামনে আসতে ব্যর্থ হয়। এদিকে মুসলিম বাহিনী তীব্র যুদ্ধের মাধ্যমে মুশরিকদের পরাস্ত করে। অনেক মুশরিক প্রাণ হারায়; ফলে তাদের ঘোড়াগুলো, তরবারী, অস্ত্রশস্ত্র ও অনেক মূল্যবান সম্পদ যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে ছিল। মুসলমানরা এ অবস্থা দেখে সেগুলো সংগ্রহ করতে তাড়াহুড়া শুরু করে দেয়। উক্ত কৌশলগত স্থানে পাহারারত ৫০ জন মুসলিম যোদ্ধা যখন গনিমতের মাল সংগ্রহের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে, তখন তারা ভাবতে থাকল আমাদের ভাগের কি হবে!? কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল যে, এগুলো হচ্ছে গনিমতের মাল, এগুলো একত্রিত করার পর যুদ্ধ শেষে সকলের মধ্যে সমভাবে বন্টন করা হবে। আল্লাহ ও রাসূল (সা.) ভালভাবে অবহিত আছেন যে, তারা সেখানে দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত রয়েছে। কাজেই উক্ত কৌশলগত স্থান ত্যাগ করা আদৌ সমীচীন হবে না। কিন্তু তারা প্রলুব্ধ হয়ে গনিমতের মাল সংগ্রহের জন্য সেখান থেকে চলে আসে। অথচ যুদ্ধের সেনাপতি তথা রাসূল (সা.) যুদ্ধের শুরুতে তাদেরকে আদেশ দিয়েছিলেন যে, তারা যেন কোন অবস্থানে উক্ত স্থান ত্যাগ না করে। এমনকি মুসলমানরা যদি মুশরিকদেরকে পরাস্ত করে মক্কা পর্যন্ত বিতাড়িত করে; তবুও তোমরা এখানেই অবস্থান করবে। পক্ষান্তরে যদি আমরা পরাজয়ের শিকার হই এবং শত্রুরা আমাদেরকে মদীনা পর্যন্ত পিছু হটিয়ে দেয়; তবুও তোমরা এ স্থান ত্যাগ করবে না। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধকৌশল এবং রাসূলও (সা.) সে কৌশলের প্রতি বিশেষভাবে তাগিদ করেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতি যে কৌশল অবলম্বনের জন্য যোদ্ধাদেরকে আদেশ দিবে, প্রত্যেকের উপর অপরিহার্য হচ্ছে যথাযথভাবে সে নির্দেশনা মেনে চলা। এক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শনের কোন সুযোগ নেই। তাদের বুঝা উচিত ছিল যে, যুদ্ধ শেষে নিশ্চয়ই প্রত্যেকের মাঝে গনিমতের মাল সমভাবে বন্টন করা হবে, কেউ তা থেকে বঞ্চিত হবে না। কিন্তু তারা সে সময় দূর্বল মানসিকতার পরিচয় দেয় এবং উক্ত কৌশলগত স্থান ত্যাগ করে। ইতিহাসের বর্ণনা অনুযায়ী উক্ত ৫০ জন যোদ্ধার মধ্যে মাত্র ১০ জন যোদ্ধা রাসূলের (সা.) আদেশ অনুযায়ী নির্দেশিত স্থান ত্যাগ না করে সেখানে অবস্থান করেন।
বিষয়টি কতইনা আপত্তিকর যে, যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ সেনাপতির নির্দেশ অমান্য করবে। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতির আদেশ অমান্য করা আল্লাহ ও রাসূলের (আ.) আদেশ অমান্য করার ন্যায়। সেনাপতি যখন আদেশ করবে সামনের দিকে এগিয়ে যাও; অবশ্যই সামনে যেতে হবে। এ নিয়মনীতি সবাইকে মেনে চলা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়-দায়িত্ব সেনাপতির উপর বর্তায়। সেনাপতি হোক, কোন বাহিনী প্রধান হোক, ফ্রন্ট প্রধান হোক কিংবা ইউনিট প্রধান হোক না কেন প্রত্যেকে এক্ষেত্রে যথারীতি স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করে থাকেন। যদি কখনও যুদ্ধক্ষেত্রের সেনাপতি আদেশ করে যে, সামনে যাও, তাহলে যেতেই হবে; যদি আদেশ করে যে, পিছু হটতে হবে, তাহলে কোন কালক্ষেপণ না করেই পিছপা হতে হবে। এখানে যেন কোন যোদ্ধা প্রশ্ন না করে যে, আমরা কি পারাজিত হয়েছি যে, পিছু হটবো? কেননা একজন সাধারণ সেনা হিসেবে তো আপনি যুদ্ধের মূল পরিকল্পনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। বরং সেনাপতি এ বিষয়ে সম্যক অবহিত। হয়তো এ পিছু হটার আদেশ শত্রুপক্ষকে ধোকা দিবার উদ্দেশ্যে জারি করা হয়েছে, হয়তো আপনি সামনে গেলে অবরুদ্ধ হতে পারেন, হয়তো সহযোগী যোদ্ধারা এখনও সামনে পৌঁছায় নি, তাই আপনি (বা আপনার সাথে কিছু সংখ্যক সৈন্য) সামনে অগ্রসর হলে সঙ্গী হারা হবেন। কাজেই এক্ষেত্রে পিছু হটা জরুরী নতুবা আপনাদের প্রাণহানীর সম্ভাবনা রয়েছে। যখন সেনাপতি আদেশ করবে সামনে এগিয়ে যাও, যখন সেনাপতি বলবে পিছনে সরে এস, যখন সেনাপতি আদেশ করবে অমুক অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে কিংবা অমুক অস্ত্র এখন ব্যবহার করা যাবে না, যখন সেনাপতি আদেশ করবে মাটিতে শুয়ে পড় কিংবা সামনের দিকে দৌঁড় দাও- সর্বাবস্থায় সেনাপতির আদেশাবলি যথাযথভাবে মেনে চলা জরুরী। এগুলো সবই যুদ্ধক্ষেত্রের মৌলিক নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত এবং ইসলামেও সেগুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে; কিন্তু তদুপরি তারা সেগুলো মান্য করে নি। তাদের সেনাপতি বারংবার আদেশ জারি করা সত্ত্বেও তারা সে আদেশ উপেক্ষা করেছিল। তাদের মধ্যে ৪০ জন যোদ্ধা উপত্যকার ঐ স্থান ত্যাগ করে গনিমতের মাল সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এটা কতই নিন্দনীয় বিষয় যে, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গনিমতের মালের প্রতি যোদ্ধাদের দৃষ্টি আবদ্ধ হবে এবং সেদিকে ঝুকে পড়বে। চাই সে গনিমত পার্থিব হোক কিংবা কৌশলগত বিষয় হোক না কেন। যুদ্ধে কোন কৌশলগত সুযোগ পাওয়া মাত্রই তার সুবিধা গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়া কখনও সমীচীন নয়। বিশেষ করে এ সুবিধা যদি এমন ব্যক্তি ব্যবহার করতে চায়; যুদ্ধে যার কোন মূখ্য ভূমিকা নেই, না সে তেমন কোন পরিশ্রম করেছে। বরং অন্যরা এক্ষেত্রে অক্লান্ত পরিশ্রম ও আত্ম বিসর্জন দিয়েছে। এখন সে এসে কৃতিত্ব প্রদর্শন করছে। এমন অবস্থা আমরা প্রায়ই বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করি।
যাইহোক, উক্ত ৪০ জন যোদ্ধা স্থান ত্যাগ করার পর সেখানে মাত্র ১০ জন যোদ্ধা অবশিষ্ট ছিল। খালিদ বিন ওয়ালীদ যখন দূর থেকে এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করল, তখন অতর্কিতে হামলা চালিয়ে উক্ত ১০ জন অনুগত যোদ্ধাকে শহীদ করে পিছন থেকে মুসলিম বাহিনীর উপর হামলা চালায়; অথচ যুদ্ধে তখন মুসলমানরা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে ছিল ও শত্রু বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিল। ধাওয়া খেয়ে যখন মুশরিকরা পালাচ্ছিল এবং মুসলমানরা মাটিতে পড়ে থাকা তাদের তরবারি ও অস্ত্রশস্ত্রগুলো সংগ্রহ করছিল। এমন সময় খালিদ বিন ওয়ালীদ তার সৈন্যদের নিয়ে মুসলমানদের উপর আকস্মিক হামলা চালায়। অপ্রস্তুত মুসলমানরা তখন গনিমতের মাল সংগ্রহে ব্যস্ত ছিল, ফলে মুসলিম বাহিনী চরম বিপর্যয়ে সম্মুখীন হয়। যে সব মুশরিক যোদ্ধা সামনের দিকে পালাচ্ছিল, তারা যখন দেখল যে, মুসলিম বাহিনী খালিদ বিন ওয়ালীদের আক্রমণের শিকার হয়ছে, তখন তারা নতুনভাবে সাহস সঞ্চার করে (যুদ্ধের ময়দানে) ফিরে আসে। মুসলমানরা চারিদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। অবস্থা এতই শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.), আমিরুল মু’মিনিন আলী (আ.) ও আবু দুজানাহ্ আনসারী ছাড়া আর কেউ শত্রুদের মোকাবেলায় সেখানে উপস্থিত ছিল না। এ যুদ্ধে স্বয়ং রাসূল (সা.) আহত হন, হযরত হামযার (আ.) ন্যায় বীর সেনাপতি শাহাদত বরণ করেন এবং মুসলমানরা আরও অনেক মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অতঃপর মুশরিকরা যখন দেখল যে, এর থেকে বেশি অগ্রসর হওয়া সম্ভব নয় -কারণ তারা ভয় পাচ্ছিল যে, মুসলমানরা পুনরায় সংঘবদ্ধ হয়ে হামলা চালাতে পারে- তখন তারা সেখান থেকে চলে যায়। অনেক ইতিহাসবিদের মতে ওহুদের যুদ্ধে যদি মুশরিকরা তাদের আক্রমণকে অব্যাহত রাখত; তাহলে সেখানে আরও অনেক মুসলমান শাহাদত বরণ করতেন, এমনকি মদীনাও শত্রুদের দখলে চলে যেত। সুতরাং ওহুদের যুদ্ধ মুসলমানদের জন্য এমনই ভয়ানক পরিস্থিতি ডেকে এনেছিল। এ যুদ্ধের পর সূরা সাফ্ফ নাযিল হয় এবং যেখানে বলা হয়- হে মুসলমানরা! তোমরা তো এত শাহাদতের দাবি করতে এবং বলতে যে, আমরা শাহাদতের জন্য উদ্গ্রীব, দুনিয়ার সম্পদ আমাদের কাছে মূল্যহীন। তাহলে কীভাবে তোমরা ওহুদের যুদ্ধে পাহাড়ের সে উপত্যকা ত্যাগ করে গনিমতের মাল সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলে? এগুলো হচ্ছে আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। এগুলোর প্রত্যেকটি বিষয় থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। আমাদের অবশ্যই সচেতন ও সজাগ থাকতে হবে। কাজেই এ সূরাতে ওহুদের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে।
অতঃপর বদরের যুদ্ধের দিকে ইশারা করা হয় এবং উল্লেখ করা হয়- স্মরণ কর, বদরের যুদ্ধে কুরাইশ গোত্রের তিন জন সাহসী বীর যোদ্ধা যথাক্রমে আলী ইবনে আবি তালিব, হামযা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব এবং আব্দোহ ইবনে হারেস ইবনে আব্দুল মোত্তালিব যখন মুশরিকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তখন তাদেরকে লজ্জাজনকভাবে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়। বদরের যুদ্ধে কাফির ও মুশরিকদের মধ্য থেকে তিন জন ব্যক্তি মুসলমানদের সম্মুখে এসে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তাদের সাথে লড়াই করার আহ্বান জানায়। এমতাবস্থায় মুসলমানদের মধ্য থেকেও তিন জন্য বীর যোদ্ধা উক্ত দাম্ভিক মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হয়। লড়াই অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ ও দীর্ঘ হয়। কেননা প্রতিদ্বন্দ্বিরা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী ও চৌকস যোদ্ধা। যদিও মুসলমানদের পক্ষীয় যোদ্ধারাও ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী ও অভিজ্ঞ অর্থাৎ হযরত হামযা, হযরত আলী এবং হযরত আব্দোহ। উভয়পক্ষই তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হয়, আঘাত পাল্টা-আঘাত এবং দীর্ঘক্ষণ হাড্ডা-হাড্ডি লড়াইয়ের পর পরিশেষে মুসলমানরা কাফিরদের পরাস্ত করে তাদের উপর বিজয় অর্জনে সক্ষম হয়। আল্লাহ তাদের এ বিজয়ে সন্তুষ্ট হন। ফলে কিছু রেওয়ায়েতের বর্ণনা অনুযায়ী এ আয়াতটি তাদের সম্পর্কে নাযিল হয়।

সম্পর্কযুক্ত পোস্ট

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Are you sure want to unlock this post?
Unlock left : 0
Are you sure want to cancel subscription?
লিংক কপি হয়েছে ✔