ওয়াকেফিয়ে ফেরকার বিরুদ্ধে ইমাম রেযা (আ.)-এর অবস্থান

by Syed Yesin Mehedi

আহলে বাইত (আ.)-এর অষ্টম ইমাম ছিলেন ইমাম আলী ইবনে মূসা রেযা (আ.)। তাঁর যুগ ছিল নানা রাজনৈতিক, মতাদর্শিক ও সামাজিক টানাপোড়েনে ভরপুর। সেই সময়ের অন্যতম বড় সমস্যা ছিল আহলে বাইত (আ.)-এর অনুসারিদের অভ্যন্তরীণ বিভেদ। এই পরিস্থিতিতে ইমাম রেযা (আ.) তাঁর অসাধারণ দূরদর্শিতা ও ঐশী জ্ঞানের মাধ্যমে সত্যের পথ স্পষ্ট করে তুলে ধরেন।
ইমাম রেযা (আ.) বিভিন্ন ভ্রান্ত ফেরকা ও মতবাদের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং মুসলমানদের পাশাপাশি আহলে বাইত (আ.)-এর অনুসারিদের মাঝেও সঠিক ইমামতের ধারণা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। তাঁর বিরোধিতার মুখে পড়া প্রধান ফেরকাগুলোর মধ্যে ছিলÑ যায়দিয়া, ইসমাইলিয়া, ফাতাহিয়া, ওয়াকেফিয়া ও গোলাত। এদের মধ্যে ওয়াকেফিয়ে ফেরকা ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং ইমাম (আ.) তাদের বিরুদ্ধেই সর্বাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
ওয়াকেফিয়ে ফেরকার উৎপত্তি ও বিশ্বাস
ইমাম মূসা আল-কাযিম (আ.)-এর শাহাদতের পর ১৮৩ হিজরিতে “ওয়াকেফিয়ে ফেরকা”র উদ্ভব হয়। এই ফেরকার অনুসারিরা বিশ্বাস করত যে, ইমাম কাযিম (আ.)-ই হচ্ছেন প্রতীক্ষিত মাহদি (আ.) এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেননি; বরং গায়েব আছেন। এই কারণে তারা ইমাম রেযা (আ.)-এর ইমামত স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানায়।
ওয়াকেফিয়ে ফেরকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য
ওয়াকেফিয়েদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তাদের নেতৃস্থানীয়দের জ্ঞান, খ্যাতি ও সমাজে প্রভাবশালী অবস্থান। অনেকেই হাদিস বর্ণনাকারী ও ফকিহ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাদের নামের আগে “ফাকিহ”, “সিকা” ও “মাশহুর” ইত্যাদি উপাধি ব্যবহৃত হতো।
এই ফেরকার মূল নেতৃত্বে ছিলেন ইমামদের নিযুক্ত “উকিল সংস্থার” প্রধানগণ, যাদের দায়িত্ব ছিল নির্দিষ্ট শর্তে ইমামদের সম্পদ ও প্রতিনিধিত্ব পরিচালনা করা। কিছু অনুসারী এই কারণে তাদের মতাদর্শের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়।
মতাদর্শ প্রচারের কৌশল
ওয়াকেফিয়েরা সাধারণ মানুষকে নিজেদের দলে টানার জন্য বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পদ্ধতি অবলম্বন করে। তারা:
নিজস্ব মত প্রচারে বই রচনা করে, ছাত্রদের শিক্ষা দেয়, ইমামদের নামে জাল হাদিস প্রচার করে, মাহদি (আ.) সম্পর্কিত বর্ণনাকে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে।
ফলে আহলে বাইত (আ.)-এর কিছু অনুসারী বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং ইমাম রেযা (আ.)-এর ইমামত অস্বীকার করে বসে।
ইমাম রেযা (আ.)-এর প্রতিরোধমূলক ভ‚মিকা
ইমাম রেযা (আ.) অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ওয়াকেফিয়েদের ভ্রান্ত চিন্তাধারার বিরোধিতা করেন। তাঁর এই অবস্থানের কারণে ওয়াকেফিয়েরা ইমাম (আ.)-এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। একইসঙ্গে গোলাত ফেরকাও তাদের পথ অনুসরণ করে ইমামের বিরোধিতার সুযোগ নেয়।
ইতিহাসে বর্ণিত আছে যে, ইমাম রেযা (আ.) মদীনায় অবস্থানকালীন সময় থেকে শুরু করে মার্ভ পর্যন্ত যাত্রাপথে নানা স্থানে ওয়াকেফিয়েদের প্রশ্নের উত্তর দেন ও তাদের ভ্রান্তি নিরসনের চেষ্টা চালান।
ইমাম রেযা (আ.)-এর গৃহীত পদক্ষেপ
ইমাম (আ.) বিভিন্ন উপায়ে ওয়াকেফিয়ে ও গোলাত মতাদর্শকে প্রতিহত করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হলোÑ
১. চিঠিপত্র ও বার্তা প্রেরণের মাধ্যমে সত্য প্রচার।
২. পত্রবিনিময় ও আলোচনার মাধ্যমে ভুল ধারণার সংশোধন।
৩. জাল ও বিকৃত হাদিস পৃথকীকরণ ও খÐন।
৪. ওয়াকেফিয়েদের মিথ্যা ভাবমূর্তি ও তাদের পরিণতি জনগণের সামনে প্রকাশ।
৫. সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের বয়কট ঘোষণা।
৬. তাদের ভ্রান্ত চিন্তার নিন্দা ও অভিসম্পাত করা।
৭. ইমামতের কেরামত প্রদর্শনের মাধ্যমে সত্য প্রমাণ করা।
ইমাম রেযা (আ.)-এর পদক্ষেপের সুফল
১. ওয়াকেফিয়ে ফেরকার অনেক অনুসারী নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে পুনরায় আহলে বাইত (আ.)-এর সত্যপথে ফিরে আসে।
২. আহলে বাইতের অনুগামীরা ওয়াকেফিয়েদের ভ্রান্ত মত সম্পর্কে সচেতন হয়।
৩. মুসলিম সমাজে স্পষ্ট হয় যে, ওয়াকেফিয়েরা ছিল বিভ্রান্ত পথে।
উপসংহার: ইমাম রেযা (আ.)-এর যুগের অন্যতম বড় ফিতনা ছিল ওয়াকেফিয়ে মতবাদ। কিন্তু তাঁর প্রজ্ঞা, যুক্তি ও ঐশী দিকনির্দেশনার মাধ্যমে তিনি এই ফেরকার বিভ্রান্তি দূর করতে সক্ষম হন। আহলে বাইত (আ.)-এর প্রতিটি ইমাম তাঁদের যুগে যেমনভাবে মুসলমানদের হেদায়াতের জন্য ভ‚মিকা রেখেছেন, তেমনি ইমাম রেযা (আ.)ও তাঁর সময়ের বুদ্ধিবিভ্রান্ত সমাজকে সত্যের পথে ফিরিয়ে আনতে অসামান্য অবদান রেখেছেন।

সম্পর্কযুক্ত পোস্ট

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More

Are you sure want to unlock this post?
Unlock left : 0
Are you sure want to cancel subscription?