মানুষের জীবন এক দীর্ঘ সফর যার প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর রহমত ও পরীক্ষার ছায়া বিরাজমান। এই জীবনে কেউ ধনী, কেউ গরিব; কেউ শিক্ষিত, কেউ অশিক্ষিত; কিন্তু সবার জন্যই এক সত্য অবিচলÑআল্লাহ তাআলা মানুষের কাজের মূল্য দেন তার আকারে নয়, বরং নিয়ত ও আন্তরিকতায়।
আমরা প্রায়ই দেখি, বড় কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি, অথচ ছোট ছোট ভালো কাজকে অবহেলা করা হয়। কেউ মনে করে, “এত সামান্য কাজ করে কী হবে?” কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে ছোট কোনো কাজই তুচ্ছ নয়। কারণ, যে কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা হয়, সেটিই প্রকৃত বড় কাজ।
ছোট ভালো কাজের গুরুত্ব কুরআনের আলোকে
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন “যে কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করবে, সে তা দেখতে পাবে। আর যে কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করবে, সেও তা দেখতে পাবে।” (সূরা যিলযাল, আয়াত ৭-৮)
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট করেছেন তাঁর দৃষ্টিতে কোনো কাজই তুচ্ছ নয়। মানুষের চোখে ছোট হলেও, আল্লাহর দৃষ্টিতে সেটি বিশাল হতে পারে।
একটি হাসি, একটি পানি পান করানো, কিংবা কারও দুঃখে সান্তনার কথা এসব সাধারণ কাজের মধ্যেও নিহিত থাকতে পারে জান্নাতের আমল।
আরও একটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করেন না।” (সূরা আত-তাওবা, আয়াত ১২০)
অতএব, আল্লাহর কাছে প্রতিটি আমল মূল্যবান; যত ছোটই হোক, তা তাঁর নিকটে হারিয়ে যায় না।
হাদীসের আলোকে ছোট আমলের মহিমা
রাসূলুল্লাহ (সা.) ছোট সৎকর্মের গুরুত্ব অসংখ্যবার তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেছেন “তোমরা কোনো সৎকর্মকে তুচ্ছ মনে করো না, এমনকি তোমার ভাইকে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাও।” (সহিহ মুসলিম, হাদীস ২৬২৬)
অর্থাৎ, একটি হাসিও সওয়াবের কাজ।
আরেকটি হাদীসে বর্ণিত আছে “একজন নারীকে ক্ষমা করা হলো, কারণ সে একটি কুকুরকে পানি পান করিয়েছিল।” (সহিহ বুখারি, হাদীস ৩৩১৮)
একটি প্রাণীর প্রতি দয়ার হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় আল্লাহ তাঁর পাপ ক্ষমা করে দিলেন।
আবার নবী (সা.) বলেছেন “জাহান্নাম থেকে বাঁচো, যদিও অর্ধেক খেজুর দান করো।” (সহিহ বুখারি, হাদীস ১৪১৭)
এই হাদীসের মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে আমলের মূল্য তার পরিমাণে নয়, নিয়তে।
আত্মিক পরিশুদ্ধি ও অন্তরের প্রশান্তি
ভালো কাজ শুধু বাহ্যিক নয়; এটি আত্মার পরিশুদ্ধি ও অন্তরের প্রশান্তির উৎস।
আল্লাহ তাআলা বলেন “নিশ্চয়ই সৎকর্মগুলো অসৎকর্মগুলো মুছে ফেলে।” (সূরা হুদ, আয়াত ১১৪)
একটি ‘সুবহানাল্লাহ’ উচ্চারণ, একবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলা এগুলো হয়তো সময় নেয় কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু আত্মিকভাবে তা বিশাল প্রভাব ফেলে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন “যে ব্যক্তি ‘সুবহানাল্লাহ ওয়া বিহামদিহি’ একশ বার পাঠ করে, তার পাপসমূহ ক্ষমা করা হবে, যদিও তা সমুদ্রের ফেনার মতো বেশি হয়।” (সহিহ বুখারি, হাদীস ৬৪০৫)
এ থেকেই বোঝা যায় একটি ক্ষুদ্র জিকিরও আখিরাতে পাহাড়সম সওয়াব বয়ে আনতে পারে।
বাস্তব জীবনের ছোট ভালো কাজ
ছোট সৎকর্মের ক্ষেত্র অগণিত
কারও সমস্যায় পাশে দাঁড়ানো
বৃদ্ধকে সহায়তা করা
মসজিদ পরিষ্কার রাখা
অশিক্ষিতকে পড়ানো
কাউকে সান্ত¡না দেওয়া
সামাজিক মাধ্যমে সত্য ও ভালো কথা প্রচার করা
এসব কাজ হয়তো সমাজে প্রচার পায় না, কিন্তু আল্লাহর কাছে অতি মূল্যবান।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন “আল্লাহ তোমাদের রূপ বা সম্পদের দিকে তাকান না; বরং তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে তাকান।” (সহিহ মুসলিম, হাদীস ২৫৬৪)
ছোট ভালো কাজ অবহেলার ক্ষতি
ছোট ভালো কাজকে অবহেলা করা মানে আল্লাহর রহমতের দরজা থেকে দূরে সরে যাওয়া।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন “জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো, যদিও অর্ধেক খেজুর দান করো; যদি তা না পারো, তবে একটি সুন্দর কথা বলো।” (সহিহ বুখারি, হাদীস ৬৫১৩)
অন্যদিকে ছোট পাপকেও তুচ্ছ ভাবা ভয়াবহ।
নবী (সা.) সতর্ক করেছেন “ছোট পাপকে অবহেলা করো না; কারণ ছোট আগুনের কণা যেমন বনভ‚মি জ্বালিয়ে দেয়, তেমনি ছোট পাপও মানুষকে ধ্বংস করে।” (মুসনাদ আহমাদ)
ছোট কাজ, বড় প্রতিদান
ইসলামের ইতিহাসে ছোট কাজের মাধ্যমে বড় মর্যাদা লাভের বহু দৃষ্টান্ত আছে।
উদাহরণ ১: এক ব্যক্তি রাস্তা থেকে কাঁটা সরিয়ে দিয়েছিল, ফলে আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করলেন। (সহিহ মুসলিম, হাদীস ১৯১৪)
উদাহরণ ২: এক নারী একটি বিড়ালকে না খাইয়ে মেরে ফেলেছিল, ফলে সে জাহান্নামে গিয়েছিল। (সহিহ বুখারি, হাদীস ২৩১৯)
এই দুটি উদাহরণ আমাদের চোখ খুলে দেয় একটি ছোট কাজ জান্নাতের চাবি, আবার একটি ছোট গুনাহ জাহান্নামের কারণ হতে পারে।
ছোট কাজের সুফল
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন
আত্মার প্রশান্তি
পাপ মোচন
সমাজে ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্ব
দুনিয়া ও আখিরাতে বরকত
উপসংহার: ছোট ভালো কাজগুলোই বড় পরিবর্তনের সূচনা করে। একটি হাসি, একটি সলাওয়াত, একটি সহানুভ‚তির আচরণ এসবই মানুষের জীবন ও সমাজে আলো ছড়ায়।
আল্লাহ তাআলা বলেন “নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়ের নির্দেশ দেন, সৎকর্মের আদেশ দেন এবং অশ্লীলতা ও অন্যায় থেকে নিষেধ করেন।” (সূরা আন-নাহল, আয়াত ৯০)
23
আগের পোস্ট