মুয়াবীয়ার আমল থেকেই সিরিয়ার মসজিদে নবী বংশকে ও হযরত আলী (আঃ) কে গালি-গালাজ করা হত। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার পর বন্দী অবস্থায় শামে উপস্থিত ছিলেন ইমাম জয়নুল আবেদীন (আঃ)। তখন এই মসজিদে হযরত আলী (আঃ) ও ইমাম হুসাইন (আঃ) কে উদ্দেশ্য করে অপমানজনক কথা বলছিল ইয়াযীদের বেতনভোগী খতিব।
ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) খতিবকে বললেন: “খতিব, তুমি ইয়াযীদকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে নিজের জন্য দোজখে স্থান তৈরি করেছ।”
অতঃপর তিনি (আঃ) ইয়াযীদের দিকে ফিরে বললেন, “আমাকেও মিম্বরে যেতে দাও, আমিও কিছু কথা বলব যাতে আল্লাহ খুশি হবেন ও উপস্থিত লোকদের সওয়াব হবে।”
উপস্থিত লোকদের চাপের মুখে ইয়াযীদ অনিচ্ছা সত্তে¡ও রাজি হয়। ইয়াযীদ লোকদের প্রতি বলেছিল,
“ইনি এমন এক বংশের লোক যারা ছোটবেলায় মায়ের দুধ পানের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানও অর্জন করতে থাকে।”
বন্দী ইমাম জয়নুল আবেদীন (আঃ) মহান আল্লাহর অশেষ প্রশংসাসূচক কিছু বাক্য বলার পর বললেন:
“হে জনতা! আল্লাহ আমাদের ছয়টি গুণ ও সাতটি মর্যাদা দিয়েছেন।
জ্ঞান, সহনশীলতা, উদারতা, বাগ্মিতা, সাহস ও বিশ্বাসীদের অন্তরে আমাদের প্রতি ভালোবাসা।
আমাদের মর্যাদাগুলো হলÑ
রাসূল (সাঃ), আল্লাহর সিংহ ও সত্যবাদী আমিরুল মু’মিনিন আলী (আঃ), বেহেশতে দুই পাখার অধিকারী হযরত জাফর আততাইয়ার (রাঃ), শহীদদের সর্দার হামজা (রাঃ), রাসূল (সাঃ) এর দুই নাতী হযরত হাসান (আঃ) ও হুসাইন (আঃ) আমাদের থেকেই, আর আমরাও তাঁদের থেকেই।
যারা আমাকে জানে তারা তো জানেই, যারা জানে না তাদেরকে জানাচ্ছি
আমার বংশ-পরিচয় হে জনতা! আমি মক্কা ও মিনার সন্তান, আমি যমযম ও সাফার সন্তান।
আমি তাঁর সন্তান যিনি হজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) তুলেছিলেন তাঁর কম্বলের প্রান্ত ধরে।
আমি ওই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্তান যিনি কাবা তাওয়াফ করেছেন ও সাই করেছেন (সাফা ও মারওয়ায়) তথা হজ্ব করেছেন।
আমি এমন এক ব্যক্তির সন্তান যাকে একরাতেই মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
আমি হুসাইনের সন্তান যাকে কারবালায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
আমি আলীর সন্তান যিনি মুর্তাজা (অনুমোদনপ্রাপ্ত)।
আমি মুহাম্মদের সন্তান যিনি বাছাইকৃত।
আমি ফাতিমাতুজ জাহরা (সাঃআঃ) এর সন্তান।
আমি সিদরাতুল মুনতাহার সন্তান।
আমি শাজারাতুল মুবারাকাহ বা বরকতময় গাছের সন্তান।
হযরত খাদিজা (সাঃআঃ) এর সন্তান আমি।
আমি এমন একজনের সন্তান যিনি তার নিজের রক্তে ডুবে গেছেন।
আমি এমন একজনের সন্তান যার শোকে রাতের আধারে জ্বীনেরা বিলাপ করেছিল।
আমি এমন একজনের সন্তান যার জন্য শোক প্রকাশ করেছিল পাখিরা।”
ইমাম (আঃ) এর খোতবা এ পর্যন্ত পৌঁছলে উদ্বেলিত জনতা চীৎকার করে কাঁদতে লাগল ও বিলাপ শুরু করল। ফলে ইয়াযীদ আশঙ্কা করল যে গণ-বিদ্রোহ শুরু হতে পারে।
সে মুয়াজ্জিনকে তখনই আজান দেয়ার নির্দেশ দিল। ইমাম (আঃ) আজানের প্রতিটি বাক্যের জবাবে আল্লাহর প্রশংসাসূচক বাক্য বলছিলেন।
যখন মুয়াজ্জিন বলল, “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ”
(আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল) তখন ইমাম (আঃ) মাথা থেকে পাগড়ী নামিয়ে মুয়াজ্জিনের দিকে তাকিয়ে বললেন:
“আমি এই মুহাম্মাদের নামে অনুরোধ করছি, তুমি এক মুহূর্ত নীরব থাক।”
এরপর ইমাম (আঃ) ইয়াযীদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এই সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ রাসূল কি আমার প্রপিতামহ না তোমার?
যদি বল তোমার তাহলে গোটা পৃথিবী জানে তুমি মিথ্যা বলছ।
আর যদি বল আমার তাহলে কেন তুমি আমার বাবাকে জুলুমের মাধ্যমে হত্যা করেছ, তাঁর মালপত্র লুট করেছ ও তাঁর নারী-স্বজনদের বন্দী করেছ?
আল্লাহর কসম, এ পৃথিবীতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই যার প্রপিতামহ হলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)।
কেন এ লোকগুলো আমার পিতাকে জুলুমের মাধ্যমে হত্যা করেছে এবং আমাদেরকে রোমানদের মতো বন্দী করেছে?
অভিশাপ তোমার ওপর যেদিন আমার প্রপিতামহ ও পিতা তোমার ওপর ক্রুদ্ধ হবেন।”
গণবিদ্রোহের আশংকায় দিশেহারা ও আতঙ্কিত ইয়াযীদ অবস্থা বেগতিক দেখে নামাজ শুরু করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ জনতার অনেকেই মসজিদ থেকে বেরিয়ে যায়।
পরিস্থিতির চাপে পড়ে সুচতুর ইয়াযীদ নিজেও ভোল পাল্টে ফেলে ইমাম হোসাইন (আঃ) ও নবী পরিবারের সদস্যদের হত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে এবং এর দায় জিয়াদের ওপর চাপিয়ে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে।
শামের মসজিদে ইমাম সাজ্জাদ (আঃ) এর উপস্থিতি ও ভাষণ
126
আগের পোস্ট