১০ই মহররম তথা আশুরার দিবাগত রাতকে “শামে গারিবাঁ” বলা হয়। এটি ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ ও ভয়াল রাত। কারবালার শহীদদের পবিত্র দেহ থেকে শিরোচ্ছেদ করা হয়েছে, এবং অশ্বারোহী সেনারা সেই দেহগুলোর উপর ঘোড়া চালিয়ে পদদলিত করেছে। এরপর ইয়াজিদের বর্বর সেনারা ইমাম পরিবারের মহিলাদের তাবু লুট করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। নবী বংশের অসহায় নারী ও শিশুরা আগুনের লেলিহান শিখা থেকে বাঁচার জন্য এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করে, বহু শিশু আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করে। কারবালার আকাশ সে রাতে রক্তিম আভায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ইতিহাসে এ রাতটি “শামে গারিবাঁ” নামে পরিচিত।
রাসুলে খোদা তাঁর জীবনের প্রতিদান হিসেবে চেয়েছিলেন যে, মুসলিম উম্মত যেন তাঁর বংশধর ও আহলে বাইতকে ভালোবাসে। অথচ সেই আহলে বাইতের প্রতি মুসলিম নামধারীদের এই নিষ্ঠুর আচরণ! একদিকে ইয়াজিদি সৈনিকদের অট্টহাস্য ও মদ্যপানে উন্মত্ততা, অন্যদিকে মস্তকবিহীন শহীদদের লাশ ঘিরে নবী পরিবারের নারীদের বুকবিদারক বিলাপ। এমন এক রাতে পৃথিবীর সবচেয়ে কঠোর হৃদয়ের পাপীও অশ্রু সংবরণ করতে পারে না।
পরদিন, ইয়াজিদের সেনারা নবী পরিবারের নারী ও শিশুদের গলায় দড়ি লাগিয়ে খালি উটের পিঠে তুলে দেয়। শহীদদের ৭২টি মস্তক বর্শার ফলায় বিদ্ধ করে শোভাযাত্রা করা হয়। নবী বংশের নারীদের পর্দাহীন করে অপমানিত করা হয়। কথিত আছে, অসুস্থ ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)-কে কাটাওয়ালা লোহার বেড়ি পরিয়ে, খালি পায়ে টেনে হিঁচড়ে কারবালা থেকে কুফা এবং কুফা থেকে দামেশকে নিয়ে যাওয়া হয়।
আশুরার শিক্ষা ও ইমাম হোসাইনের আদর্শ: ইমাম হোসাইন (আ.) আশুরা বিপ্লবের মাধ্যমে মানবতাকে শিখিয়ে গেছেন সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতেও মানবীয় মর্যাদা ও শিষ্টাচার বজায় রাখতে হবে। বিপদ ও শঙ্কা মানুষকে আপোষে বাধ্য করে, কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সাথীরা ষড়যন্ত্র, হুমকি, এমনকি নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে এক চুলও সরে যাননি।
তাঁদের চরিত্রের মধ্যে ছিল আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা, আত্মোৎসর্গ, সাহসিকতা ও মানবীয় মূল্যবোধের উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এ বিপ্লবের অলৌকিকতা ছিল এই যে, যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও নৈতিকতা ও মানবতা ধ্বংস হয়নি। কারণ এই আদর্শ ও ন্যায়ের প্রতিই ছিল তাঁদের সংগ্রাম।
হুরের অনুতাপ ও শাহাদাত: শত্রু সেনাদের প্রথম দল যার নেতৃত্বে ছিল, সেই হুর ইবনে ইয়াযিদÑশুধুমাত্র ইমামের মানবিক আচরণের কারণে হৃদয় পরিবর্তন করে ইমামের সাথী হয়ে শহীদ হন। আশুরার দিন হুরের সেনারা পিপাসার্ত ছিল, তখন ইমাম হোসাইন (আ.) তাঁর সাথীদের দিয়ে হুরের সৈন্যদের পানি পান করান। এই মানবিকতা হুরের অন্তরে এতটাই রেখাপাত করেছিল যে, শেষ পর্যন্ত তিনি ইমামের পক্ষ নিয়ে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেন।
আবুল ফজল আব্বাসের বীরত্ব: কারবালার ময়দানে আত্মোৎসর্গের আরেক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন হযরত আবুল ফজল আব্বাস। তিনি ছিলেন ইমামের ভাই এবং তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসায় নিবেদিত। ফোরাত নদী থেকে পানি আনতে গিয়ে যখন তিনি নিজেই তৃষ্ণার্ত অবস্থায় ছিলেন, তখন ইমামের তৃষ্ণার্ত শিশুদের কথা মনে করে নিজে পানি পান না করে পানির মশক ভরে শিবিরে ফেরার চেষ্টা করেন। পথেই শত্রুদের হাতে তিনি নির্মমভাবে শহীদ হন।
জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম:
ইমাম হোসাইন (আ.) আমাদের শিখিয়ে গেছেন, ইসলামের মৌলনীতি থেকে বিচ্যুত শাসকের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতেই হবে যদি তা প্রাণ বিসর্জন দিয়েও করতে হয়। তাঁর আত্মত্যাগ ইসলামকে রক্ষা করেছে, এবং সেই আত্মত্যাগ আজও বিশ্বের প্রতিটি ন্যায়প্রেমিক মানুষকে প্রেরণা জোগায়।
কারবালার কাহিনী প্রচারে হযরত জেইনাব (সা.)-এর ভ‚মিকা: কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার বার্তা ছড়িয়ে দেয়ার গুরুদায়িত্ব বহন করেছেন ইমাম হোসাইন (আ.)-এর বোন হযরত জেইনাব (সা.) এবং পুত্র ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)। হযরত জেইনাব (সা.) ইসলামী বিপ্লবের নারী নেত্রী হিসেবে কারবালার পরবর্তী সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। তাঁর প্রচারণার মাধ্যমেই “হাল মিন নাসির ইয়ানসুরুনা?”Ñইমামের এই চিরন্তন ডাক পৌঁছে যায় সমগ্র মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে।
উপসংহার: কারবালা শুধু একটি ট্রাজেডি নয়, বরং মানবতার মহান পাঠশালা। ইমাম হোসাইন (আ.) ও তাঁর সাহসী সাথীদের আত্মত্যাগ, আল্লাহর প্রতি ভরসা এবং সত্যের পথে দৃঢ় থাকা আমাদের শেখায় কিভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়। আজকের দিনে মুসলিম সমাজের জন্য এই শিক্ষাই সবচেয়ে প্রয়োজন
শামে গারিবাঁ: কারবালার হৃদয়বিদারক রাত
99