লেখকঃ মল্লিক শিহাব ইকবাল
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, মানুষের মধ্যে এমন কিছু লোক রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি অথচ আদৌ তারা ঈমানদার নয়। (সূরা বাকারা ঃ ৮)
এমন চবিত্রের লোক যুগে যুগে ছিল, রয়েছে এবং থাকবে। যাদের পরিচয় কারবালার প্রান্তরে পরিষ্কার করা হয়েছে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তাদের মতো ঈমানদার-পাকা মুসলমান খুঁজে পাওয়া যাবে না। পোশাক-আশাক, বেশভূষা তার বাগাড়ম্বরে তারা অতুলনীয়। কিন্তু ঈমানের দাবিতে ত্যাগ, আনুগত্য, বিসর্জন ও খোদাভীতির প্রশ্ন দেখা দিলে তাদের আসল রূপ প্রকাশ হয়ে যায়। তাদেরই নেতা ভন্ড ইসলাম প্রেমিক ইয়াজিদ ও তার দোসররা সম্পূর্ণরূপে দুনিয়াবী স্বার্থের জন্য ক্ষমতার লোভে ইতিহাসের নির্মমতম অধ্যায় রচনা করেছিল। প্রায় ১৪শ’ বছর আগের সেই ঘটনা আজও মুমিন নর-নারীর অন্তরে আগ্নেয়গিরির অন্তর্দাহ জ্বালিয়ে নয়নে অশ্রুধারা বইয়ে দেয়।
ধর্র্মের মূল বন্ধন কেটে ডাল-পালায় বাহ্যিক অঙ্গ সজ্জায় আল্লাহ সন্তুষ্টি হয় না। দুনিয়ার মানুষকে ধোকা দেয়া যেতে পারে কিন্তু রাসুলের শাফায়াত লাভের জন্য তা কোন উপকারে আসবে না। নিজেদের ক্ষমতা সুরক্ষিত করার অভিলাষে নবী বংশকে ধ্বংস করতে ইয়াজিদ বাহিনীর চক্রান্ত ইসলামের জন্য অপূরণীয় ক্ষতির কারণে হয়েছিল। যাদের চক্রান্ত শুরু হয়েছিল রাসূল (সাঃ) এর সময় থেকেই। তারা সুযোগের প্রতীক্ষায় থাকতো। কোরআনকে তারা বুকে ধারণ করতে পারেনি। তাই ১১ হিজরিতে রাসূল (সাঃ) এর ওফাতের পর ক্রমান্বয়ে তাদের দুষ্কর্মের মাত্রা বৃদ্ধি পেল। মাত্র ৩০ বছরের মধ্যে ইসলামের ইতিহাসে ৪ খলিফার মধ্যে ৩ জনকে শহীদ করা হলো। ৩৬ হিজরীতেই সংঘটিত হল উষ্ট্রের যুদ্ধ, যাতে প্রায় ১০ হাজার সাহাবী প্রাণ হারান। একই হিজরী সনে সিফফিনের যুদ্ধ হলে হযরত আলী (আঃ) ও মুয়াবিয়ার মধ্যে, যাতে প্রায় ৭০ হাজার সাহাবীকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছিল। ভ্রাতৃঘাতী সিফফিনের যুদ্ধের ফলে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট হয়ে যায়। যা মুয়াবিয়ার কারণে সংঘটিত হয়েছিল।
মুসলমানদের মধ্যে এসব চক্রান্তকারীর পরিচয় আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন এভাবে, হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিত ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক এবং অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ কর না। (সূরা আলে-ইমরান ঃ ১০২)
আল-কোরআনের বর্ণনা মতে, তারা মুসলমান হয়েছে কিন্তু ঈমানদার হতে পারেনি। তাই জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবীরা ও রাসুল (সাঃ) এর আহলে বায়েতের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে তাদের অন্তরাত্মা প্রকম্পিত হয়নি। কথিত ইতিহাসের দৃষ্টিতে মুয়াবিয়া রাসূল (সাঃ) এর সাহাবী ছিলেন কিন্তু নির্বাচিত খলিফার বিরুদ্ধাচরণ করেছেন, যুদ্ধ করেছেন এবং তার পুত্র ইয়াজিদ তারই পথ অনুরণ করেছে। তারা রাসুল (সাঃ) এর আহলে বায়েতকে পৃথিবী থেকে চিরতরে নাম মুছে ফেলার জন্য ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়েছে। মুয়াবিয়ার চক্রান্তে বিষ প্রয়োগ করে ইমাম হাসান (আঃ)কে শহীদ করা হয় এবং ইয়াজিদের সেনাদের হাতে ইমাম হোসাইন (আঃ) কারবালার প্রান্তরে নির্মম শাহাদতবরণ করেন।
কোন ঈমানদার মুসলমান রাসূল (সাঃ) এর আদরের নাতি এবং খাতুনে জান্নাত মা ফাতিমার কলিজার টুকরার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণের কথা ভাবতেও পারেন।?! রাসুল (সাঃ) বলেছেন, আমি হোসাইন থেকে এবং হোসাইন আমার থেকে। তিনি বহুবার প্রিয় নাতিদ্বয়কে কাঁধে নিয়ে বলেছেন, হে প্রভু, আমি ওদের ভালোবাসি, আপনিও তাদের ভালোবাসবেন, তারা আমাকেই ভালোবাসে। আর যারা এ দু’জনের সঙ্গে শত্রুতা করবে তারা আমার সাথে শত্রুতা বলে গণ্য হবে। তিনি তাদের মুসলিম উম্মাহর দুই সুবাসিত ফুল বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি এই দুই নাতির সঙ্গে খেলতেন, বুকে চেপে ধরতেন, চুমু খেতেন এবং তাদের ঘ্রাণ নিতেন। নামাজের সময় তারা নানার পিঠে বসলে নানা সিজদা থেকে উঠতেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই নেমে যেতেন। তারা এভাবে রাসূল (সঃ) এর সংস্পর্শে প্রতিপালিত হন এবং শিশুকাল থেকে রাসূল (সাঃ) এর বিশেষ তত্ত্বাবধানে নবুয়্যত ও রেসালতের একান্ত সাহচর্যে বড় হয়ে উঠেন। রাসুল পাক (সাঃ) ছিলেন জীবন্ত কোরআন, যার যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছিল ইমাম হোসাইন (আঃ) এর মধ্যে। তিনি কোরআনকে বক্ষে ধারণ করে রাসূলের আদর্শে জীবন পরিচালনা করেছিলেন। ৬০ হিজরীতে মৃত্যুর কিছুদিন আগে মুয়াবিয়া তার মদ্যপ ও লম্পট ছেলে ইয়াজিদকে মুসলমানদের খলিফা ঘোষণা করে। তখন ইমাম হোসাইন (আঃ) বলেন, আমি যদি মদিনা শহরে অবস্থান করি এরা আমাকে ইয়াজিদের বায়াত গ্রহণ করতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমি কখনও বায়াত গ্রহণ করতে পারবো না। তারা বাধ্য করলে নিশ্চয় যুদ্ধ হবে। আমি চাই না মদিনা শহরে লড়াই বা ফ্যাসাদ হোক। তখন তিনি আত্মীয় পরিজনসহ মদিনা থেকে হিজরত করে মক্কায় হেরেম শরিফে অবস্থান করছিলেন। সেখানে ইবাদত বন্দেগী করে বাকী জীবন কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু অভিশপ্ত চক্রান্তকারীরা তার পিছু ছাড়েনি। মিথ্যা আশ্বাসে তাকে কুফায় আহ্বান করে এবং পথে কারবালা প্রান্তরে নবী বংশের ১৮ জনসহ ৭২ জনকে নিমর্ম নিষ্ঠুরভাবে শহীদ করে। অতঃপর পৈশাচিকভাবে ইমাম হোসাইন (আঃ) এর মাথা কেটে সীমাহীন ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে। যার মাধ্যমে সমাধি রচিত হল রাসূলের ইসলাম আর কোরআনের নীতি আদর্শের। জন্ম নিল নতুন এক মেকি ইসলাম।
মুহাম্মদী গোলাপকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল ওই ইয়াজিদ নামক নামাজি মুসলমানরাই। যারা বলেছিল, দ্রুত হোসেনের মাথা কেটে আনবে, যেন আসরের নামাজ কাজা না হয়। তারা ভুলে গেল আল্লাহ ও রাসুলের সব বাণী। ভুলে গেল তাদের নামাজের মধ্যে দরূদে ইব্রাহিমের কথা। নামাজের মধ্যে তারা অবশ্যই পড়েছে “আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মদিও ওয়া আলে মুহাম্মদ।” এরকম নামাজির সংখ্যা দুনিয়ায় আজ বেড়েছে বৈ কমেনি। তারা মুসলমান পরিচয় দেয় অথচ ১০ মহররম নবী বংশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশার্থে আলোচনা শোক মজলিস, মাতম ইত্যাদির পরিবর্তে ইয়াজিদের বানানো মিথ্যা খুশির দিন পালন করে। যারা মহররমে নিজেদের শামিল করেন তাদেরও মনে রাখা প্রয়োজন আহলে বায়েতের ৬ষ্ঠ ইমাম জাফর সাদেক (আঃ) এর বাণী। তিনি বলেছেন, “মুমিনদের জন্য প্রতিটি দিনই আশুরা এবং প্রত্যেক জমিন কারবালা।”#####