সৈয়দ মোহাম্মদ আলী
“নারী যখন কন্যা তখন সে রহমত, নারী যখন বোন তখন সে নেয়ামত, নারী যখন স্ত্রী তখন সে আমানত, নারী যখন মা তখন সে জান্নাত।”-হযরত আলী (আ.)
নারী শব্দটি খুবই ছোট মনে হলেও উক্ত শব্দটির মাহত্ব এবং ফজিলত অনেক বড়। “নারী” অর্থৎ “মায়ের” জাতি। আর এই নারী জাতি একজন পুরুষ এর জীবনে ভিন্ন ভিন্ন সম্পর্কের রূপ হিসাবে প্রকাশ পেয়ে থাকে। কখনো তারা কন্যা আর কখনো সে বোন কখনো সে স্ত্রী আবার কখনো সে মমতা ময়ী মা।
পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস রয়েছে। সেই সকল বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ইসলাম একমাত্র ধর্ম যে ধর্ম দিয়েছে নারী জাতির সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা। ইসলাম ধর্মের মতোই একই মর্যাদা বা অধিকার অন্য কোনো ধর্ম নারী জাতিকে দিতে না পারার কারণ হিসাবে আমি মনে করি, ধর্মীয় অনুশাসন ও ধর্মীয় রীতিনীতি। বিভিন্ন ধর্মে নারী জাতির মর্যাদা ইসলাম ধর্মের থেকে কম হওয়ার কারণ ধর্মীয় যে প্রভাব গুলো রয়েছে তা বিভিন্ন ধর্মের নাম ও উদাহরণ স্বরূপ আপনাদের মাঝে সংক্ষিপ্ত ভাবে তুলে ধরবো। তার আগে চলুন একটু লেখার শুরুতে ফিরে যাই, লেখার শুরুতে হযরত আলী (আ.) এর যে বাণীটি দিয়ে শুরু করেছিলাম উক্ত বাণীতে চারটি সম্পর্কের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। উক্ত বাণীতে যে চারটি সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে তা হলো, কন্যা, বোন, স্ত্রী এবং মা। আসুন দেখি ইসলাম উক্ত চারটি সম্পর্কের বিষয় কি ফজিলত ও মর্যাদার কথা বলেছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করি।
ইসলামে কন্যা সন্তানের ফজিলত ও মর্যাদা :
একজন পিতার নিকট কন্যা সন্তান মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকর্তৃক প্রেরিত রহমত স্বরূপ। রাসূলে খোদা (সা.) বলেছেন, যখন কোনো ব্যক্তির কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে, সেখানে আল্লাহ তায়ালা ফেরেস্তাদের পাঠান। তারা গিয়ে বলেন, তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, হে গৃহবাসি! তারা কন্যােিক তাদের ডানার ছায়ায় আবৃত করে নেয়, তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় এবং বলে একটি অবলা জীবন থেকে আরকটি অবলা জীবন ভূমিষ্ঠ হয়েছে এবং তত্ত¡াবধায়নকারী কেয়ামত পর্যন্ত মহান আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্ত হবে।” (মুজাসুস সাগীর, হাদিস নং-৭০)
এছাড়াও রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, “কন্যা সন্তান হলো উত্তম সন্তান, কেননা, তারা হচ্ছে অধিক গুণের অধিকারীনী বিন¤্র ও মিষ্টভাষী। এছাড়া তারা যারা মমতাময়ী , বিনয়ী ও বরকতময়ী।”
এছাড়াও আর অনেক অনেক ফজিলত রয়েছে। কন্যা সন্তান এর সব থেকে বড় মর্যাদা কন্যা সন্তানদের জন্য রাসূলে খোদা নিজে করে দেখিয়েছেন তার প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা (সা.আ.)কে “মা” বলে ডাকতেন। এর মাধ্যমে রাসুলে খোদ বুঝিয়েছেন যে প্রত্যেক কন্যা সন্তান তার পিতার কাছে মায়ের সমতুল্য। রাসুলে খোদা (সা.) নিজের কন্যা সন্তানকে ভালবেসে বুঝিয়ে পিয়েছেন কিভাবে কন্যা সন্তানদের ভালবাসতে হয়। এছাড়া মহান আল্লাহ আজ পবিত্র কুরআনুল কারীমে কন্যা সন্তানের বরকত ও ফজিলত সম্পর্কে অধিক আয়াত নাযিল করেছেন এবং এর মাধ্যমেই বোঝা যায় ইসলামে কন্যা সন্তানের ফজিলত ও মর্যাদা কতটা বেশি।
এবার দেখি ইসলামে বোন এর মর্যাদা বা অধিকার সম্পর্কে আমাদের কি বলেছে :
পৃথিবীতে রক্তসম্পর্কীয় আপনজনের মধ্যে পিতা ও মাতার পরে সবথেকে ভালবাসা ও মধুর সর্ম্পক হচ্ছে ভাই ও বোনের সম্পর্ক। ইসলাম একমাত্র ধর্ম যে ধর্মে বোনকে মায়ের সমান বলা হয়েছে। রাসূলে খোদা (সা.) বলেছেন, “পৃথিবীতে সকল ভাইয়ের নিকট তাদের বোন আল্লাহর দেয়া নেয়ামতস্বরূপ।” এর মাধ্যমেই বোঝা যায় বোন আল্লাহর দেয়া কত বড় একটি নেয়ামত। সকল ভাইদের উচিৎ তাদের বোনদের যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান এর মাধ্যমে আল্লাহ পাকের নেয়ামত এর সঠিক সম্মান দেয়া।
আসুন এখন দেখি ইসলাম ‘স্ত্রী’ সম্পর্কে কি বলেছে :
ইসলামী শরীয়াতে অনেক হুকুম রয়েছে মহান আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে। এই সকল হুকুমগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হুকুম হলো বিবাহ। বিবাহর মাধ্যমে একজন পুরুষ ও নারীর মধ্যে বৈধ ও বরকতময় জীবনের শুরু হয়। যাদের বলা হয় স্বামী ও স্ত্রী। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনুল কারীমে বলেন, “তারা তোমাদের আবরণ এবং তোমরা তাদের আবরণ।” (সূরা বাকারা-১৮৭)
উক্ত আয়াত দ্বারা মহান আল্লাহ পাক স্বামী ও স্ত্রী এর যে সুন্দর ও পবিত্র সম্পর্ক তা প্রকাশ করেছেন। ইসলাম আমাদের বলেছে একজন স্ত্রী তার স্বামীর নিকট আমানত। আবার সেই স্ত্রীই তার স্বামীর জন্য নেয়ামত। শুরুতে যে হাদিস দ্বারা লেখা শুরু করেছিলাম উক্ত হাদিসে সর্বশেষ যে সর্ম্পকের কথা বলা হয়েছে সেটি হলো ‘মা’।
আসুন দেখি ইসলাম আমাদের মা এর ফজিলত ও বরকত সম্পর্কে কি বলেছে। পবিত্র কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেছেন, “তোমাদের পালনকর্তা আদেশ করছেন, তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করোনা এবং মাতা পিতার সাথে সদাচরণ করো। তাদের মধ্যে কেউ একজনও যদি তোমার জীবদ্দশায় বাধ্যকে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলোনা এবং তাদের ধমক দিওনা। তাদের সাথে আদবের সাথে কথা বলো।” (সূরা বনি ইসরাঈল : ২৩)
উক্ত আয়াত দ্বারা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের বুঝিয়েছেন যে, ইসলামে মহান আল্লাহর পরে মাতা পিতার অধিকার সবথেকে বেশি। এছাড়া রাসূলে খোদা (সা.) বলেন, মহান আল্লাহ পাক মায়ের অবাধ্য হওয়াকে তোমাদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন।” (সহীহ মুসলীম : ৪৫৮০)
‘হাদীসে কুদসি’তে উল্লেখ আছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, “তাদের জন্য সুখবর পৌঁছে দাও, যে নিজের ‘মা’কে খুশি রাখে সে আমাকে খুশি রাখে, আর যে আমাকে খুশি রাখে তার জন্য জান্নাত নিশ্চিত রয়েছে।” এর দ্বারা বোঝা যায় ‘মা’ তার সন্তানের জন্য কত বড় একটি নেয়ামত। তাকে খুশি রাখলে জান্নাত নিশ্চিত করেছেন। তার ফজিলতে বলা হয়েছে “জান্নাত মায়ের পদতলে” (কানজুল উম্মাল : ৪৫৪৩৯)
লেখার শুরুতে হযরত ইমাম আলী (আ.) এর যে হাদিস দ্বারা শুরু করা হয়েছিল উক্ত হাদিসে নারীর চারটি রূপ বা সম্পর্ক অনুযায়ী তাদের ইসলাম কতটা মর্যাদা বা ফজিলত দান করেছেন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা জানলাম।
আসুন এখন ইসলাম ধর্মের সাথে অন্য কিছু ধর্ম মিলিয়ে দেখি কোন ধর্মে নারীর মর্যাদা কতটুকু :
হিন্দু ধর্মে নারীর মর্যাদা : হিন্দু ধর্মে নারীদের জন্য রয়েছে কঠোর বিধান যা অন্য কোনো ধর্মে পাওয়া যায়না। যে সকল কঠোর প্রথার কিছু কিছু আজও পর্যন্ত হিন্দু ধর্মে বহাল রয়েছে। সতীদাহের মতো কঠোর প্রথা হিন্দু ধর্মে ছিল। কোনো নারীর স্বামীর মৃত্যুর পর তাকে সহানুভুতি দেখানো তো দূরের কথা মৃত স্বামীর সাথে তাকে জীবন্ত চিতায় জালিয়ে দেয়া হতো। তাদের ধারণা বা বিশ্বাস ছিল স্বামীর লাশের সাথে জীবন্ত দগ্ধ না হলে তার স্বর্গ লাভ সফল হবে না।
এছাড়াও হিন্দু ধর্মের কোনো নারী বিধবা হলে সমাজে, আত্মীয় সজন, বন্ধু-বান্ধব এমনকি নিজ ঘরেও তার কোনো সম্মান থাকতো না। এছাড়া হিন্দু আইনে নারীকে ন্যৃনতম সম্পত্তির অধিকার দেয়া হয়নি। বাবা বা স্বামীর সম্পত্তিতে মেয়েদের কোনো অধিকার নেই। তাদের বিবাহের সময় উপহার স্বরূপ তাদের যা দেয়া হয় তাকেই সম্পত্তির সাথে গণ্য করা হয়। কিন্তু যুগের সাথে তালমিলিয়ে হিন্দু ধর্মের এই সকল কঠোর প্রথার অনেকটা পরিবর্তন ঘটেছে।
খ্রিষ্টান ধর্মে নারীর মর্যাদা : ইসলাম ধর্মের একজন পয়গম্বর হলেন হযরত ঈসা (আ.)। কিন্তু খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারিদের মতে হযরত ঈসা (আ.) হলেন ¯্রষ্টার পুত্র। তারা মনে করেন, ¯্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক হলো পিতা ও পুত্রের সম্পর্ক। ¯্রষ্টা হলেন পিতা আর সৃষ্টির প্রতিনিধি যীশু (হযরত ঈসা (আ.) হলেন পুত্র।
পবিত্র কুরআনুল কারীমে অনেকবার বলা হয়েছে যে, ঈসা (আ.) হলেন মরিয়াম নামের একজন নারীর পুত্র। কিন্তু খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারিরা তা বিশ্বাস করেনা। তারা মনে করেন হযরত ঈসা (আ.) আকাশ থেকে আশা একজন পুরুষের পুত্র। খ্রিস্টান ধর্মের নারীদের এর কারণে মর্যাদা এবং সম্মান নেই বললে চলে। তারা মনে করেন নারীরা পাপের উৎস। কিন্তু ব্যাপার হলো, আধুনিক যুগের সাথে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে তারা পরসস্পরকে বন্ধু মনে করেন।
আসুন সর্বশেষে দেখি ইসলাম নারীর মর্যাদা বা সম্মান সম্পর্কে কি বলেছে :
পৃথিভীতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নারী পুরুষ উভয় সৃষ্টি করেছেন। নারী অর্থাৎ ‘মা’ এর জাত আর পুরুষ অর্থাৎ ‘পিতার’ জাত। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অনেক গুনাবলী রয়েছে তার সেই সকল গুনাবলীগুলোর অনেকটাই নারীজাতির মধ্যে তিনি দান করেছেন। যেমন দয়া মহান আল্লাহর সবে থেকে বড় একটি গুণ। আর পিতা-মাতার মধ্যে আমরা সবথেকে দয়ালূ যাকে জানি তিনি হলেন ‘মা’ অর্থাৎ ‘নারী’। একমাত্র ইসলাম নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদা। ইসলামের আগমনের আগেই সামাজিকভবে নারীদের কোন মর্যাদা ছিলনা। নারীদের প্রতি করা হতো অমানবিক আচরণ। এমনকি সেই যুগে কন্যা সন্তানকে জীবন্ত হত্যা করা হতো। এই সকল জাহিলি যুগের অবসান ঘটে আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর আগমনের পর থেকে। রাসূলে খোদা (সা.) নারীকে সর্বোচ্চ সম্মান দান করেছেন যর বর্ণনা তাঁর অনেক হাদিসে পাওয়া যায়।
রাসূলে খোদা (সা.) বলেন, “মায়ের পায়ের নিচে রয়েছে জান্নাত”।
উক্ত হাদিস দ্বারা রাসূলে খোদা (সা.) সকলকে আগে থেকে সাবধান করে দিয়েছেন যাতে নারীজাতি অর্থাৎ মায়ের জাতের সাথে কেউ খারাপ বা অন্যায় না করে। এর দ্বারা বোঝা যায় ইসলামে নারীর মর্যাদা কতটা বেশি।
মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে সকল ধর্মের অনুসারীদের নারীজাতিকে সম্মান ও মর্যাদা দানের তওফিক দান করুন। (এলাহি আমিন)###