ইসলামের মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর তাঁর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.)-এর জীবনে নেমে আসে অসীম দুঃখ ও নিঃসঙ্গতা। পিতার বিচ্ছেদে শোকে মূর্ছিত এই মহীয়সী নারী একদিকে প্রিয় নবীর বিয়োগ ব্যথা সহ্য করছিলেন, অন্যদিকে আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.)-এর খেলাফতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও অবিচারের দৃশ্য তাঁকে মানসিকভাবে ভীষণভাবে আঘাত করেছিল।
‘বাইতুল আহযান’ শোকের ঘর
রাসূলের ইন্তেকালের পর হযরত ফাতেমা (সা.আ.) প্রতিদিন তাঁর পিতার কবর যিয়ারতে যেতেন এবং অঝোরে অশ্রু ঝরাতেন। কখনো শহীদদের কবরের পাশে বসে আহাজারি করতেন, আবার কখনো ঘরের কোণে একাকী শোক পালন করতেন।
মদীনাবাসীদের অনুরোধে আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) ‘জান্নাতুল বাকী’ কবরস্থানের এক প্রান্তে তাঁর জন্য একটি ছোট ঘর নির্মাণ করেন। সেই ঘর পরবর্তীতে পরিচিতি পায় ‘বাইতুল আহযান’ বা ‘শোকের ঘর’ নামে। প্রতিদিন সকালবেলা তিনি তাঁর দুই পুত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইন (আ.) কে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যেতেন এবং দিনভর প্রার্থনা ও ক্রন্দনে কাটাতেন। এই অবস্থা তাঁর অসুস্থ হয়ে পড়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
আযানের ধ্বনি ও ফাতেমার ব্যথা
নবীজির প্রিয় মুয়াযযিন হযরত বেলাল (রা.) রাসূলের ইন্তেকালের পর আর কখনো আযান দেবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কিন্তু একদিন হযরত ফাতেমা (সা.আ.) বললেন,
“আমার পিতার মুয়াযযিনের কণ্ঠে একবার আযান শুনতে ইচ্ছে করছে।”
বেলাল তাঁর অনুরোধে আযান শুরু করলে, “আল্লাহু আকবার” উচ্চারিত হতেই ফাতেমা (সা.আ.)-এর চোখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। আর যখন তিনি “আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ” পর্যন্ত পৌঁছান, তখন ফাতেমা যাহরা (সা.আ.) উচ্চস্বরে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। উপস্থিত লোকেরা বেলালকে থামতে অনুরোধ করেন। কিছুক্ষণ পর চেতনা ফিরে পেলে ফাতেমা (সা.আ.) তাঁকে আযান সম্পূর্ণ করতে বললেও, বেলাল বলেন
“হে নারীদের নেত্রী, আমি আশঙ্কা করছি আমার আযানের ধ্বনি আপনার প্রাণনাশের কারণ হবে।”
চিরবিদায়
ক্রমাগত মানসিক আঘাত ও শারীরিক দুর্বলতায় হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.) এক সময় শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। একাদশ হিজরির জামাদিউল উলা মাসের ১৩ তারিখে (কারো মতে জামাদিউসসানি মাসের ৩ তারিখে) তিনি ইন্তেকাল করেন। নবী করীম (সা.)-এর তিরোধানের মাত্র পঁচাত্তর বা পঁচানব্বই দিন পর, প্রিয় কন্যার এ বিদায় গোটা মুসলিম সমাজকে শোকে নিমজ্জিত করে তোলে।
তাঁর শাহাদাত আজও বিশ্বাসীদের হৃদয়ে চিরজাগরূক এক স্মৃতি। হযরত ফাতেমা যাহরা (সা.আ.)-এর ধৈর্য, ত্যাগ ও বেদনা নারী জাতির জন্য এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে আহব্বান হয়ে আছে।
তথ্যসূত্র: বাইতুল আহযান, মুনতাহাল আমাল, কানযুল ফাওয়ায়েদ, আমালী, কাশফুল গুম্মাহ, বিহারুল আনওয়ার।
37
আগের পোস্ট
